পাচারের অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে সাদ মুসা গ্রুপের জমি ক্রয়!

যুক্তরাষ্ট্রে সেকেন্ড হোম গড়তে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মার্কিন ডলার পাচারের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসিনের বিরুদ্ধে। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ‘২৮৭৫ সাম্পসন এভিনিউ, করোনা’ এলাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনাসহ কেনা এ জমি নিয়ে সেখানকার আদালতে মামলা হওয়ার পর বিষয়টি ফাঁস হয়। নজরে আসে এনবিআরের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই বিদেশে সম্পত্তি কেনার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে তার আয়কর রিটার্নেও। পরে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাচারকৃত অর্থের একটি অংশ জব্দও করেছে ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড সুপিরিয়র আদালত। পাচারের অর্থ ফেরত আনতে আইনজীবীও নিয়োগ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছে এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। এছাড়া কর ফাঁকি, আয়কর রিটার্নে বিদেশে বিনিয়োগের বিষয়টি প্রদর্শন না করার দায়ে তার বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা হয়েছে। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা যায়। বিদেশে অর্থ পাচার এবং তা ফেরত আনার বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইসি’র যুগ্ম-পরিচালক ড. নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত চলছে।
তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেয়া হবে। তিনি বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নয়, নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি পাচারের অর্থ দেশে ফেরত আনা দরকার। আশা করি সেটি সম্ভব হবে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে অর্থ পাচারের এ ঘটনা অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে জানায় এনবিআর। পরে যুগান্তরের পক্ষ থেকে বিশদ অনুসন্ধান চালানো হয়। আদালত থেকে মামলার নথি সংগ্রহ করতে গিয়েও বহু গলদঘর্ম হতে হয়। সংশ্লিষ্ট জিআরে (সাধারণ নিবন্ধন শাখা) দীর্ঘ সময় ধরে খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি মামলার নথি। কারণ জানতে চাইলে জিআরের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জামিনের জন্য আসামি মামলার নথি জিআর থেকে নিয়ে যান, ফেরত আসেনি। পরে মামলার নথি সংগ্রহ করা হয় সংশ্লিষ্ট থানা থেকে। সংগ্রহ করা হয় সংশ্লিষ্ট সব নথিও। নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যবসায়ী মহসিনের আয়কর রির্টানে অনেক তথ্যই নেই। আয় গোপন করে তিনি বিদেশে অর্থ পাচার করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তেও অনুমোদন ছাড়াই বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচারের বিষয়টি উঠে আসে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার রিয়েল স্টেট ব্রোকার ‘স্টারাটা রিয়েলিটি ইন্টারন্যাশনাল’ এর সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট মি. আদম সিলভারম্যানের মাধ্যমে জমি কেনার প্রস্তাব করেন মোহাম্মদ মহসিন। পরে তিনি ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৬৯ ডলারে জমিটি ক্রয় করেন। মূল্য পরিশোধ করা হয় ‘টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি এসক্রো কর্পোরেশনের ব্যাংক হিসাবের (এসক্রো নম্বর-৩৪৪৩৩-১) মাধ্যমে।
মূল্য পরিশোধ শেষে ব্যাংক হিসাবটি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং মহসিনের নামে (নম্বর-২০১২-০৪৪৮৫৬০) জমির রেজিস্ট্রেশনও হয়। জমির কর পরিশোধ করা হয় এসোসর পার্সেল নম্বর (এপিএন) ১৭২-৩৯০-০৪০-৮ এর মাধ্যমে। বছরে করের পরিমাণ ৭ হাজার ৮৩৬ ডলার। ২০১৪ সালে মহসিনের নামে কেনা জমি ‘জেল্টমোর ৪জি এলএলসি, নিউ মেক্সিকো লিমিটেড লাইবিলিটি’ নামের একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন জনৈক সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। নতুন দলিলের রেজিস্ট্রেশন নম্বর-২০১৪-০১২১৯৬০। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ মহসিন ওই বছর ৮ এপ্রিল ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড সুপিরিয়র আদালতে মামলা করেন (নম্বর আরআইসি-১৪০৪২২৭)। দুই বছর পর ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আদালতের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে আপস চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী অভিযোগকারী মোহাম্মদ মহসিনকে দেড় লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধের অঙ্গিকার করেন সাইফুল ইসলাম। এদিকে অর্থ পরিশোধের আগেই গোপন সূত্রে গোটা বিষয়টি জানতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআর। তদন্তে এর সত্যতাও খুঁজে পায়। পরে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের মাধ্যমে গত ১৫ সেপ্টেম্বর আইনি সহায়তা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ বরাবর আবেদন করা হয়। তাতে আদালতে চলমান মামলা এবং দেড় লাখ ডলার লেনদেন স্থগিতের আবেদন করা হয়। একই সঙ্গে মহসিনের কেনা সম্পত্তির বৈধতা নিয়ে আরও তদন্ত এবং বিষয়টি ফৌজদারি অপরাধে বিচারের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া আবেদনে উল্লেখিত অর্থ বাজেয়াপ্ত করে তা বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। বাংলাদেশের আবেদনে সাড়া দিয়ে মার্কিন আদালত ওই অর্থ জব্দ করার নির্দেশও দিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইসির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ক্যালফোর্নিয়ার আদালতে মোহাম্মদ মহিসনের বক্তব্যে প্রমাণ হয় ওই টাকা তিনি দেশ থেকে পাচার করে নিয়ে গেছেন। আশা করছি জব্দ করা অর্থ দেশে ফেরত আনা সম্ভব হবে। আইনি লড়াই চলছে। তিনি বলেন, ফৌজদারি এবং ফিন্যান্সিয়াল অপরাধ ভিন্ন।
ফিন্যান্সিয়াল অপরাধের ক্ষেত্রে অনেক সময় আদালত গ্রেফতারের আদেশ দিয়ে থাকেন। তবে আদালত থেকে এখন পর্যন্ত এ ধরনের নির্দেশ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেনি। অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন যুগান্তরকে বলেন, যে সম্পত্তি নিয়ে অভিযোগ, তা আমার বোনের টাকায় কেনা। আমার কাছে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আছে। ঘটনা সঠিক নয়। আমার একজন স্টাফ এনবিআরের কাছে অভিযোগ দিয়ে এ ক্ষতি করেছে। সরকার না বুঝে এতকিছু করেছে। দেশের সর্বোচ্চ করদাতা আমি। আমার কোনো বক্তব্য নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, একজন রফতানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েই বছরে ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করতে পারি ব্যবসায়িক প্রমোশনে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটায় বিদেশে মোট রফতানি আয়ের ১০ শতাংশ ব্যয় করতে পারব ওয়্যার হাউজ বাবদ। আমি ২শ’ থেকে ৪শ’ কোটি টাকার পণ্য রফতানি করছি। ওই হিসাবে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা এমনিতেই ব্যয়ের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তারা কোনো উত্তর দেয়নি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) তদন্ত : ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে সিআইসি জানতে পারে যে, ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্যবসায়ী মহসিন ক্যালিফোর্নিয়ায় অকৃষি (বাণিজ্যিক স্থাপনাসহ) জমির মালিক থাকলেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে দাখিল করা আয়কর রিটার্নে ওই জমির কথা উল্লেখ করেননি। মোহাম্মদ মহসিনের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইন)-৩১৪১৯১৫৮৬৭০৪। তদন্তে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ মহসিন গোপন আয়ের ওপর প্রযোজ্য কর ফাঁকি দেয়ার মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ১৬৫ ও ১৬৬ ধারা অনুযায়ী অপরাধ করেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত : বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিভাগ তদন্ত করে দেখতে পায় ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেটরি অ্যাক্ট ১৯৪৭’ এর অধীনে গত ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণের জন্য মোহাম্মদ মহসিন ও তার স্ত্রী কোনো অনুমোদন নেননি। তদন্তে বলা হয়েছে, নিয়মবহির্ভূত অর্থ পাচার করে সম্পত্তি অর্জন করেছেন মহসিন, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২(ফ) ধারার এবং একই আইনের ধারা ৪(২) অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে বলেছেন, বিদেশে অর্থ পাচার প্রতিরোধ নিয়ে বিএফআইইউ কাজ করছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে। আরও অধিক তদন্তের জন্য অর্থ পাচারের কয়েকটি ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব তথ্য পেলে নিজ উদ্যোগে তদন্ত করছে।
সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপন : যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের ঘটনাটি গত ডিসেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১৬তম বৈঠকে সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ বা সেকেন্ড হোম তৈরি করা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থে। তবে তাদের বিরুদ্ধে এনবিআর কার্যক্রম গ্রহণ করছে। সেখানে আরও বলা হয়, মোহাম্মদ মহসিনের বিরুদ্ধে বিদেশের এ বিনিয়োগ প্রদর্শন না করাসহ কর ফাঁকির অভিযোগে তিনটি মামলা করা হয়েছে। জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. মো. আবদুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, বিদেশে পাচারকৃত এ অর্থ দ্রুত দেশে ফেরত আনা এবং দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। এজন্য কিছু সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয়ে ইতিপূর্বে বেশ কিছু সুপারিশ করা হলেও খুব বেশি অগ্রগতি হচ্ছে না। এ নিয়ে আমাদের চরম অসন্তোষ রয়েছে।
কে এই মহসিন : মোহাম্মদ মহসিন সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ব্যবসায়িক ঠিকানা ২৪৫ হাটহাজারী রোড, বিবিরহাট, চট্টগ্রাম। এছাড়া সাদ মুসার সিটি সেন্টার, ক-১৮৯ যমজ রোড, কুড়িল বিশ্ব রোড, বাড্ডা-ঢাকায়ও একটি ব্যবসায়িক ঠিকানা রয়েছে। তবে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আরও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ গ্রুপের। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ফেব্রিক্স বোর্ড লি., সাদ মুসা ফেব্রিক্স লি., এমএ রহমান ডায়িং ইন্ডাস্ট্রি, সাদ মুসা হোম টেক্সটাইল অ্যান্ড ক্লথিং লি., দেশ কম্পিউটার, মার্স অটোমোবাইলস, সাদ মুসা হাউজিং কমপ্লেক্স, কর্ণফুলী জুট ট্রেডিং, সাদ মুদা গ্রুপ ইন্ডাস্ট্রিসহ আরও অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.