ফুলতলায় সিরিজ কিলিংয়ের শিকার সরদার পরিবার

সিরিজ কিলিংয়ের শিকার খুলনার ফুলতলা উপজেলার সরদার পরিবার। বৃহস্পতিবার রাতে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও দু’দফায় নির্বাচিত ফুলতলা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মিঠু (৪২) দুর্বৃত্তদের গুলিতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। রাজনীতিতে নেমে এর আগে খুন হন তার বাবা সরদার আবুল কাশেম এবং বড় ভাই আবু সাইদ বাদল। এ দু’জনই দামোদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। মিঠুর মতো একই স্টাইলে তার বাবা ও ভাইকে খুন করে দুর্বৃত্তরা। বর্বর জিঘাংসার শিকার ওই পরিবারের সদস্যরা এখন রাজনীতিই ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এদিকে একই পরিবারের তিনজনের এভাবে খুন হওয়ার বিষয়টিকে একই সুতোয় গাঁথা বলে মনে করছেন অনেকে।
তাদের মতে, এর পেছনে শক্তিশালী গডফাদারদের হাত রয়েছে। খুলনা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও দু’দফায় নির্বাচিত ফুলতলা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মিঠু (৪২) বৃহস্পতিবার রাতে দামোদর নতুন হাট এলাকার নিজ বাড়ির সামনে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভেতর খুন হন। তিনি শ্বশুরসহ কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মী নিয়ে কোনো একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেলে ডিবি পুলিশের জ্যাকেট ও হেলমেট পরিহিত সশস্ত্র ৩-৪ ব্যক্তি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির সামনে আসে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির গেটে থাকা তার (মিঠু) দেহরক্ষী নওশের আলীকে (৫০) গুলি করে কক্ষে ঢুকে মিঠুর মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মিঠুর শ্বশুর ও উপজেলা বিএনপি নেতা সৈয়দ ফজলুল আলম সেলিম (৫৬) ও তার অপর দেহরক্ষী সিরাজ মোড়ল (৫১) আহত হন। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি খুনিরা। হত্যাকাণ্ডের পর তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শাটারে ২৭ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে পুরো এলাকায় ভীতি ছড়িয়ে বীরদর্পে চলে যায়। আহতদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় নওশের আলীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে ওই রাতেই সেখানে তার মৃত্যু হয়। বাকিদের ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
দলীয় নেতাকর্মীদের ভাষ্য : খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘এটি ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড। রাজনীতির কারণে একটি পরিবারের জনপ্রিয় নেতাদের প্রকাশ্যে একে একে হত্যা করা হচ্ছে। আর হত্যা করে খুনিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে খুনিরা উৎসাহিত হচ্ছে।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এর আগে দু’দফা মিঠুকে হত্যার চেষ্টা করা হলেও প্রশাসন তাকে রক্ষায় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।’ পায়ে গুলিবিদ্ধ সৈয়দ ফজলুল আলম সেলিম (মিঠুর শ্বশুর) যুগান্তরকে বলেন, এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। মিঠুর কোনো শত্রু নেই। তার বাবা ও ভাইয়ের হত্যাকারীরাই মিঠুকে হত্যা করেছে। হত্যার ধরনও একই। এর পেছনের অন্যতম কারণ মিঠু ও তার পরিবারের জনপ্রিয়তা।’
আর রাজনীতি করবেন না মিঠুর পরিবারের সদস্যরা : নিহত বিএনপি নেতা আলাউদ্দিন মিঠুর জীবিত তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজ ভাই সরদার সেলিম যুগান্তরকে বলেন, ‘জনগণের সেবা করাই আমাদের পরিবারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের ভালোবাসায় আমার বাবা ও ভাইয়েরা শক্তিশালী হয়েছিল। প্রতিপক্ষ জনপ্রিয়তায় হেরে গিয়ে আমাদের বাড়ি পুরুষশূন্য করে চলেছে। আমরা জীবিত তিন ভাই ব্যবসা-বাণিজ্য করে সংসার চালাই। জনগণ চাইলেও আমরা আর রাজনীতির পথে পা বাড়াব না। কারণ আমরা বাঁচতে চাই।’ নিহত মিঠুর প্রথম স্ত্রী ক্যান্সার আক্রান্ত জোবায়দা খান সুরভী বলেন, ‘যারা আমার শ্বশুর ও ভাসুরকে হত্যা করেছে তারাই আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। সব খুনি একই সুতোয় গাঁথা। কিন্তু প্রকৃত খুনি ও তাদের গডফাদারদের পুলিশ কখনো আটক করতে না পারলেও আমার স্বামী ও শ্বশুরের নামে মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা হয়েছে বহুবার।’ তিনি আরও বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগে আমার স্বামীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাড়ি থেকে ডেকে খুলনা শহরে নিয়ে সতর্কভাবে চলাফেরা করার পরামর্শ দেয়।’ তিনি দাবি করেন, ‘আমার স্বামীর জীবন নিয়ে সংশয় থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তাকে রক্ষা করতে পারেনি।’
পুলিশের বক্তব্য : ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান মুন্সী শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ময়নাতদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী মিঠুকে শটগান দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে ৬টি শটগানের গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে (শুক্রবার ভোরে) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দামোদর গ্রামের বাসিন্দা খোরশেদ শেখের ছেলে মো. ইমরুল শেখকে (২৭) আটক করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে হত্যার কারণ সম্পর্কে এ মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না।’ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম শফি উল্লাহ বলেন, ‘তিনটি বিষয় মাথায় রেখে মিঠু হত্যার তদন্ত করা হচ্ছে। প্রথমত, বাবা ও ভাই হত্যার দুটি মামলার বাদী আলাউদ্দিন মিঠু। দ্বিতীয়ত, তিনি জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। আগামীতে প্রার্থী হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে মিঠু হত্যায় বেনিফিশিয়ারি কোনো পক্ষ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। তৃতীয়ত, দলের মধ্যেই মিঠুর দ্রুত উত্থান হচ্ছিল। দলের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার জেরে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মামলা হয়নি বলে থানা সূত্রে জানা গেছে।
নেপথ্যের কারণ : ফুলতলায় দুটি প্রভাবশালী বংশের ভূঁইয়া ও সরদারদের মধ্যকার বিরোধ বহু পুরনো। মিঠু সরদারের বাবা ও ভাই এ দুই চেয়ারম্যান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি প্রভাবশালী শিমুল ভূঁইয়া ও বর্তমান দামোদর ইউপি চেয়ারম্যন শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া শিবলু। শিবলু ভূঁইয়ার বড় ভাই লাকি ভূঁইয়ার ছেলে তানভীর ভূঁইয়া মাস দুই আগে নাইন এমএম পিস্তলসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। বর্তমানে সে জামিনে রয়েছে। শিবলু ভূঁইয়ার চাচাতো ভাই চরমপন্থী ক্যাডার মোমিনুর ভূঁইয়া মিঠুর বাবা কাশেম ভূঁইয়া হত্যা মামলার আসামি। বর্তমানে সে বিদেশে রয়েছে। মিঠুর বড় ভাই সরদার আবু সাইদ বাদল খুন হওয়ার পর উপনির্বাচনে বাদলের স্ত্রী জাকিয়া হাসিন বিনা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর পরবর্তী নির্বাচনে শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া শিবলু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। মিঠুর পরিবারের অভিযোগ তিন হত্যার যোগসূত্র একটিই।
বিএনপির হরতালসহ ৪ দিনের শোক : মিঠু হত্যার প্রতিবাদে আজ ভোর ৬টা হতে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খুলনা মহানগর ও জেলায় সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এছাড়া এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৪ দিনের শোক কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুর পৌনে ১২টায় কেডি ঘোষ রোডের মহানগর বিএনপি কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট এসএম শফিকুল আলম মনা। ৪ দিনের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারণ, আজ হরতাল চলাকালে বেলা ১১টায় কেডি ঘোষ রোডে দলীয় কার্যালয়ের সামনে জেলা ও মহানগর বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ এবং খুলনা বিভাগের অপর ৯ জেলায় বিক্ষোভ; ২৮ মে রোববার বেলা ১১টায় হবে শোক সভা ও দোয়া মাহফিল; ২৯ মে হত্যার বিচার দাবিতে ডিআইজি ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের কাছে স্মারকলিপি পেশ। প্রেস ব্রিফিংয়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ফুলতলার এক চরমপন্থী নেতা শাসক দলে যোগদানের পর থেকে মিঠু জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। এদিকে শুক্রবার বিকালে মিঠুর লাশ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে ফুলতলায় আনা হয়। এখানে জানাজা শেষে রাতে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
সহজেই মেলে ভাড়াটে খুনি : ভৌগোলিক কারণে খুলনার ফুলতলায় চরমপন্থী ও নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন পার্টির রাজত্ব চলছে বহু বছর ধরে। এখানকার নেপথ্যের গডফাদার বা হোয়াইট কালার ক্রিমিনালরা প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে এসব পার্টির ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার করে।
বাবা-ভাই খুন : আলাউদ্দিন মিঠুর পিতা দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেম ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট দুপুরে ফুলতলা ইউএনও অফিসের মধ্যে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন। পিতার ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর মিঠুর বড় ভাই আবু সাইদ বাদলকে ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে খুলনা যশোর মহাসড়কে ছবেদা তলা নামক স্থানে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে।

No comments

Powered by Blogger.