বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশি অ্যাকশন

সুপ্রিমকোর্ট চত্বরের ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদে শুক্রবার বের হওয়া বিক্ষোভ মিছিলের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল ও জলকামান থেকে রঙিন পানি ছুড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। এদিন দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে মিছিলটি বের হয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মৃদু সংঘর্ষও হয়। এটি শিশু একাডেমি ও টিএসসি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দীসহ চারজনকে। আন্দোলনকারীদের দাবি, পুলিশের অ্যাকশনে তাদের অন্তত ২০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার আদেশেই ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকালে তিনি ভাস্কর্যটি অপসারণের আদেশ দেন। এরপর রাতের মধ্যেই জাতীয় ঈদগাহ মাঠের পাশ থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে সুপ্রিমকোর্টের পেছনে রাখা হয়। এই ভাস্কর্যটি সুপ্রিমকোর্ট মিউজিয়ামের সামনে রাখা হতে পারে। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করেন বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় ‘মৌলবাদের সঙ্গে সরকারের আপস রুখে দাঁড়াও’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের দাবিতে ‘ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ’ ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল করেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারী সংগঠনের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, উদীচী, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট এবং ছাত্রঐক্য ফোরামসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন।
রাজু ভাস্কর্য থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের দিকে যাওয়ার পথে সুপ্রিমকোর্ট মাজারসংলগ্ন শিশু একাডেমির সামনে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন আন্দোলনকারীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর সোয়া ১২টার দিকে শিশু একাডেমি পার হওয়ার পরপরই পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেড অতিক্রম করতে চাইলে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে রঙিন গরম পানি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এতে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পরে তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে এসে দফায় দফায় মিছিল করেন। এ সময় তারা সরকারের ‘মৌলবাদ তোষণনীতি’র বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থল থেকে চারজনকে আটক করা হয়েছে। আটকদের মুক্তির দাবিতে দুপুরের পর শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। পুলিশের পক্ষ থেকে আটকদের ছেড়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়া হলে দেড় ঘণ্টা অবস্থানের পর থানার সামনে থেকে চলে যান আন্দোলনকারীরা। ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি তুহিন কান্তি দাস যুগান্তরকে জানান, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী ছাড়া আটক অন্য তিনজন হলেন ছাত্র ইউনিয়ন লালবাগ থানা শাখার নেতা জয়, ঢাকা কলেজ শাখার সভাপতি মোর্শেদ হালিম, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আরিফ নূর। এ ঘটনায় ২০ থেকে ২৫ জন আহত হয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি। ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাতেই তাৎক্ষণিকভাবে আন্দোলনে নেমেছিলেন বিভিন্ন গ্রগতিশীল সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ভাস্কর্য অপসারণের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে সুপ্রিমকোর্টের সামনের রাস্তায় সমবেত হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন গণজাগরণ মঞ্চের একদল কর্মী। পরে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রফ্রন্ট নেতাকর্মীরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। তারা ভাস্কর্যটিকে ন্যায়বিচারের প্রতীক উল্লেখ করে তা আদালত প্রাঙ্গণ থেকে অপসারণের প্রতিবাদ জানান। একপর্যায়ে তারা সুপ্রিমকোর্টের ফটকে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে রাত ৩টার দিকে ভাস্কর্য সরানোর কাজ কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে আশপাশের বাতিগুলো নিভিয়ে দেয়া হয়। এরপর রাত ৪টার দিকে ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হয়। ভাস্কর্য অপসারণের কাজ শেষ হওয়ার পরও ঘণ্টাখানেক অবস্থান করে বিক্ষোভকারীরা সুপ্রিমকোর্টের সামনে থেকে চলে যান। এর আগে শুক্রবারের কর্মসূচি ঘোষণা হয়। এরই অংশ হিসেবে শুক্রবার রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন তারা। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের একাংশের সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রী চক্রবর্তী রিন্টু বলেন, শিশু একাডেমির সামনে যাওয়ার পরপরই জলকামান, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে পুলিশ। এতে ছাত্রফ্রন্টের সঞ্জয় কান্তি দাস, শামীমা আরা মিনা, মুক্তা ভট্টাচার্যসহ অনেকে আহত হন। এ ব্যাপারে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন বলেন, হাইকোর্টের সামনে কেউ বিক্ষোভ করতে পারেন না। আন্দোলনকারীদের বলেছি, যা করার দূর থেকে করুন। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেনি। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস শেল নিক্ষেপ করার কথা স্বীকার করেন তিনি।
শনিবার সন্ধায় তিনি যুগান্তরকে জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে চারজনকে আটক করে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। অপসারণের আগে সবার মতামত নেয়া হয় : অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুগান্তরকে বলেন, বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় প্রধান বিচারপতি ‘ফুল কোর্ট’ (হাইকোর্টের সব বিচারক) ডেকেছিলেন। সবার মতামতের ভিত্তিতেই ‘ভাস্কর্য অপসারণের’ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে এটা সুপ্রিমকোর্টের অন্য কোনো স্থানে স্থাপন করা যেতে পারে। অনেক আইনজীবীই ভাস্কর্যটি সুপ্রিমকোর্টের মিউজিয়ামের কাছে স্থাপন করতে মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেন, অনভিপ্রেত কোনো পরিস্থিতি যেন সুপ্রিমকোর্টে সৃষ্টি না হয়, সে কারণেই এটা (ভাস্কর্য) সরানো হয়েছে। মূলত এটা (সুপ্রিমকোর্ট) একটা সম্মানের স্থান। এখানে যদি কেউ এসে ভাংচুরের চেষ্টা করে তাহলে এটা হবে আদালতের জন্য অসম্মানজনক। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভাস্কর্য অপসারণের আগে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ সাবেক নেতা, একজন সরকারদলীয় এমপিসহ প্রায় ১০ জনের সঙ্গে ভাস্কর্য অপসারণের বিষয়ে কথা হয় প্রধান বিচারপতির। জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন যুগান্তরকে বলেন, প্রধান বিচারপতি কোনো বিতর্কের মধ্যে জড়াতে চান না। যেহেতু বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন রকম কথাবার্তা হচ্ছে, বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। তাই তিনি এটা সরানোর সিদ্ধান্ত নেন। সমিতির সম্পাদক এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘ভাস্কর্য সরানোর বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির আলোচনা হয়েছে। এক আলোচনায় তিনি (প্রধান বিচারপতি) বলেছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ভাস্কর্য আছে। এমনকি ইরানেও আছে। আমি তো বুঝতে পারিনি এ নিয়ে বিতর্ক হবে।’ এরপর তিনি সবার মতামত নেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিমকোর্টকে বিতর্কের বাইরে রাখতে হবে। সুপ্রিমকোর্ট হবে মানুষের আস্থার আশ্রয়স্থল। তিনি (প্রধান বিচারপতি) চান না, যে তাকে নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হোক। তাই কোনো চাপে নয়, বিতর্কের অবসান ঘটাতে তিনি ভাস্কর্যটি অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন। সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্যটি স্থাপনের পর থেকে হেফাজতসহ কয়েকটি ইসলামী সংগঠন এর বিরোধিতায় নামে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবিতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠান। বিবৃতিতে ভাস্কর্যটিকে মূর্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মূর্তি সরানো না হলে তারা আবারও শাপলা চত্বর ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেবেন বলে জানান সংগঠনটির নেতারা। পবিত্র রমজান শুরুর আগেই ভাস্কর্যটি না সরালে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে আসছিল ধর্মভিত্তিক দলগুলো। অপরদিকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রগতিশীল ব্যক্তিরা ভাস্কর্যটি অপসারণের বিরোধিতা করে আসছিল।
প্রতিবাদ ও নিন্দা : হাইকোর্টের সামনে ভাস্কর্য অপসারণ ও প্রতিবাদকারীদের ওপর পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), মহিলা পরিষদ প্রভৃতি। বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের সামনে থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীকী ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়ার কাজটি রাতের অন্ধকারে করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম, আওয়ামী ওলামা লীগসহ ধর্মান্ধ ধর্মব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ফিকিরবাজ সংগঠন ও সংস্থার চাপে শাসক দল ভোটের সমীকরণে প্রতারণামূলক কৌশলে এ কাজ করিয়েছে। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি জানায়, হেফাজতসহ মৌলবাদীদের কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জানায়, হেফাজতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রগতিশীল ও অমুসলিমদের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে মাস্টার্সের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সুপ্রিমকোর্টের সামনে থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হয়েছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস জানিয়েছেন, ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে শনিবার বিকাল ৫টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
আজ বিক্ষোভ : আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের দাবিতে আজ শনিবার সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে ‘ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ’। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স যুগান্তরকে বলেন, শনিবার সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি ছাড়াও বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের উদ্যোগে শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। দলের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল সফল করতে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.