সুগন্ধি-সম্রাটের হাতেই সরকার গঠনের চাবি? by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

হিসাবটা মোটামুটি এ রকম। আজ বরাক উপত্যকা ও উজান আসামের প্রথম দফার যে ভোট হতে চলেছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আট, বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ সাত এবং সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিং, নিতিন গড়কড়ি ও স্মৃতি ইরানিরা মোট ৪৯টি জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। এঁদের মোকাবিলায় সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী এবং আনন্দ শর্মা, সালমান খুরশিদ, জয়রাম রমেশ, গোলাম নবী আজাদ ও রাজ বাব্বরেরা করেছেন ৪৫টা জনসভা। এই হিসাবের সঙ্গে চট করে চোখ বোলানো যাক ভোটের তিন দিন আগে প্রকাশিত জনমত জরিপের রিপোর্টে। দেখা যাচ্ছে, ১২৬ আসনের বিধানসভায় বিজেপি ও তার জোট সঙ্গীরা পাচ্ছে ৫৫টি আসন। ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে কংগ্রেস, ৫৩টি আসন পেয়ে। রাজ্যের তৃতীয় শক্তি সুগন্ধি-সম্রাট বদরুদ্দিন আজমলের এআইইউডিএফ জিতছে ১২টি আসনে। জনসভার ক্ষেত্রে বিজেপি ও কংগ্রেসের যা ফারাক, জনমত জরিপের ফারাকও প্রায় ততটাই। নির্যাস একটাই, আসামের ভোটে কংগ্রেসকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দৌড় করাচ্ছে বিজেপি। শেষমেশ ফল যদি ‘ফটো ফিনিশের’ মতো হয়, তাহলে বলা যেতে পারে, এক চুল হলেও বিজেপি এগিয়ে এবং কিংমেকার হতে চলেছেন বদরুদ্দিন আজমল। সরকার গড়তে হলে কংগ্রেসকে এই প্রথম দফার ৬৫ আসনের মধ্যে অন্তত ৪৫টি জিততেই হবে। বরাক উপত্যকা ও উজান আসামই কংগ্রেসের মূল ঘাঁটি। বিদায়ী বিধানসভায় এই ৬৫ আসনের মধ্যে ৫৪টিই ছিল তাদের দখলে। পাঁচ বছর আগের সেই সুদিন এখন কংগ্রেসের নেই। বরাকের তিন জেলায় তাদের পাঁচ বিধায়ক দলত্যাগী। বিজেপিও কোমর কষে নেমেছে। মোদি-শাহ জুটির কাছে আসাম দখল জীবন-মরণের প্রশ্ন। পাঁচ বছর আগে এই ৬৫-র মধ্যে তাদের দখলে ছিল মাত্র তিনটি। এবার তারা তিনের পাশে একটা শূন্য বসাতে মরিয়া। জরিপ অনুযায়ী অবশ্য বিজেপির তুলনায় কংগ্রেসের ভোটের শতাংশের হার বেশি। বিজেপির ৩৩-এর তুলনায় কংগ্রেস পাচ্ছে ৩৭ শতাংশ ভোট। কিন্তু ভোটের হারের সঙ্গে আসনপ্রাপ্তির যে সব সময় তালমিল ঘটে, তা নয়। গত লোকসভার ভোটে রাজ্যের ১৪টি আসনের মধ্যে সাতটি জিতেছিল বিজেপি। সেই জয় তাদের এবার ১৫ বছরের কংগ্রেস একাধিপত্যের অবসানে আশাবাদী করে তুলেছে। সে জন্য বিজেপি বিধানসভা ভোটে হাত মিলিয়েছে অসম গণপরিষদ ও বোড়ো পিপলস ফ্রন্টের সঙ্গে। কংগ্রেসকে ভাঙিয়ে দলে টেনেছে তরুণ গগৈর একসময়কার ডান হাত হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে। তরুণ গগৈর রাজনৈতিক জীবনে এত বড় চ্যালেঞ্জ আগে আসেনি। এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ৮০ বছরের ‘তরুণ’ কিন্তু অচঞ্চল। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে সোনিয়া-রাহুলকে বাধ্য করেছেন তিনি। সফল আতর ব্যবসায়ী এআইইউডিএফ প্রধান বদরুদ্দিন আজমলের সঙ্গে জোট বাঁধার জন্য তাঁর ওপর চাপ ছিল। বদরুদ্দিন আজমলও আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তরুণ আপাতত ‘একলা চলো’ নীতিতেই এগিয়েছেন। ১৫ বছরে আর যা-ই হোক আসামকে অশান্ত হতে দেননি তরুণ গগৈ। অর্থনীতির ওপর জোর দিতে অবকাঠামোর দিকে নজর দিয়েছেন। বিজেপি এলে রাজ্যে হানাহানি বাড়বে—এটাই তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রচার। এ রাজ্যের বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্নটি বড়ই স্পর্শকাতর। বরাবরই এই প্রশ্ন নির্বাচনী ইস্যু হয়ে ওঠে। বিজেপি এই বিশ্বাসই এত বছর ধরে দিয়ে এসেছে। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর এই লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার দুটি নোটিশ জারি করে। অমিত শাহ বরাক উপত্যকার জনসভাগুলোতে বলেছেন, এ বিষয়ে তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট। রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই তাঁরা এই বিল নিয়ে আসবেন। এ জন্য বিধানসভায় সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। কিন্তু বিজেপির দুই জোট সঙ্গী এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে সহমত নয়। বরাকের হিন্দু বাঙালিরাই বিজেপির ভরসা। নাগরিকত্বের প্রশ্নে তারাই আবার ধন্দে। শেষ হাসি কে হাসবে, কংগ্রেস ও বিজেপির নেতারা আজকের ভোটের পরেই তা বুঝে যাবেন। মোদি-শাহ জুটির চাপ আরও বাড়বে, নাকি কংগ্রেস কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে, আসামের ফলেই তা বোঝা যাবে। দুশ্চিন্তাহীন শুধু বদরুদ্দিন আজমল। কংগ্রেস বা বিজেপি কারও পক্ষেই নিশ্চিত ফল না হলে সুগন্ধি-সম্রাটের হাতেই থাকবে সরকার গঠনের চাবিকাঠি। বদরুদ্দিন আজমলের টেনশন তাই সবার চেয়ে কম।

No comments

Powered by Blogger.