সংগঠিত নারী আন্দোলন ও মহিলা পরিষদ

নারীর জন্য কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ছাপিয়ে অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নারীসমাজকে সচেতন ও সংগঠিত করতে ভিন্ন ধারার স্বেচ্ছাসেবী জাতীয় গণনারী সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়াস ছিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের। ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা নেত্রীরা ‘সচেতন হও, নিজের অধিকার বুঝে নাও, সংগঠিত হও, আন্দোলন গড়ে তোলো’—নারীসমাজের প্রতি এই আহ্বান জানিয়ে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। মহীয়সী নারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ডাক ছিল, ‘ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন—অগ্রসর হউন! বুক ঠুকিয়া বলো মা! আমরা পশু নই; বলো কন্যে। আমরা জড়োয়া অলংকাররূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বলো, আমরা মানুষ!’ তাঁর সেই কণ্ঠস্বরই মহিলা পরিষদের সব কর্মকাণ্ডে অনুরণিত হয়েছে। ‘মহিলা পরিষদের প্রতিটি কর্মী-সংগঠককে হতে হবে একেকটি মহিলা পরিষদ’—প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি সুফিয়া কামাল কর্মী ও সংগঠকদের বিভিন্ন সভায় প্রায়ই এ কথা বলতেন। সেই সংগঠন নারীমুক্তির সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ক্রমে সমগ্র বাংলাদেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে। বর্তমান সমাজের সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেশি দৃশ্যমান। নারী তাঁর যোগ্যতা দিয়ে সমাজে স্থান করে নেওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছেন। নানা প্রতিকূলতা, চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে চলছে নারীর অগ্রযাত্রা। তাঁর এই সম্ভাবনাময় অগ্রসরমাণ প্রক্রিয়াকে সুসংগঠিত করা মহিলা পরিষদ তথা আজকের নারী আন্দোলনের দায়িত্ব। বিভিন্ন পেশার নারীরা একদিকে যেমন কর্মক্ষেত্রে বিদ্যমান অধস্তনতা দূর করে অধিকার আদায়ের আন্দোলন করবেন, একই সঙ্গে মূলধারার নারী আন্দোলনে সব শ্রেণি-পেশার নারীর সমস্যা ও অধিকারের দাবিগুলো অন্তর্ভুক্ত করবেন—সেটাই কাম্য হয়েছে। যদিও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীদের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা রয়েছে, যা নিয়ে আলাদাভাবে আন্দোলন সংগঠিত করার প্রয়োজন অনুভূত হয়। কিন্তু নারীর অধস্তনতা ও অধিকারহীনতার মূল হচ্ছে নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা সব শ্রেণি-পেশার নারীর ক্ষেত্রে একইভাবে বিরাজমান। এই বৈষম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেই নারীর আন্দোলন ও সংগ্রাম। নারী যত সচেতন হচ্ছেন, নারী আন্দোলন তত বেশি সংগঠিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ হয়ে উঠছে এবং নারীর প্রতি রক্ষণশীল সমাজ ও ধর্মীয় মৌলবাদের আঘাতও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে নারীর ভূমিকা আজ উল্লেখযোগ্য। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র পোশাকশিল্পে ৯০ শতাংশ শ্রমিক নারী। শিক্ষায় অংশগ্রহণে বাংলাদেশের নারীরা আজ এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শীর্ষে অবস্থান করছেন। ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরে যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে, তার ৫০ শতাংশ ছাত্রী। মাধ্যমিক পর্যায়ে তা আরও বেশি, অর্থাৎ ৫৩ শতাংশ। কিন্তু আমরা জানি, উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে আসতে আসতে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। কর্মের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে নারী অনুপস্থিত। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে ইটভাটার শ্রমিক, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং পেশা, শান্তি মিশন থেকে হিমালয়ের চূড়ায় নারী তাঁর পদচিহ্ন রাখছেন। তবে সর্বক্ষেত্রে যোগ্যতা প্রদর্শন ও স্থান করে নেওয়ার জন্য নারীকে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা, চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হচ্ছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নারীর প্রতি সংবেদনশীল বিভিন্ন আইন তৈরি হয়েছে। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এর মতো অগ্রসর আইন প্রণীত হয়েছে। আগে পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতাকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করা হতো, সে ক্ষেত্রে আইনের চোখে এখন তা অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব সংবেদনশীল আইনের দাবি তোলা, খসড়া প্রণয়ন, চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে মহিলা পরিষদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নারীর অগ্রগতির ক্ষেত্রে নানা ইতিবাচক লক্ষণের পাশাপাশি যে নেতিবাচক চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা বিশেষ উদ্বেগজনক। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা সব অগ্রগতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সেই বছর ৪ হাজার ৪৩৬টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ধর্ষণ ৮০৮টি, গণধর্ষণ ১৯৯টি। (১৪টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জরিপকৃত) এটি বিভিন্ন পত্রিকার সূত্রের তথ্য, এর বাইরে আরও সহিংসতার ঘটনা রয়েছে অজানা ও অচিহ্নিত। বিগত দুই মাসের নারী ও কন্যাশিশু সহিংসতার চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। সাম্প্রতিক সময়ে তনু হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা এমন একটি স্থানে ঘটেছে, যাকে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বলে গণ্য করা হয়। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা যত দিন সামাজিক অগ্রগতির সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত না হয়ে নারীর সমস্যারূপে বিবেচিত হবে, তত দিন এই সহিংসতা দূর করার প্রয়াস হীনবল হয়ে থাকবে। মৌলিক কতগুলো ক্ষেত্রে নারীর অধিকারহীনতা ও বৈষম্যের কারণে মানুষ হিসেবে নারী পূর্ণ অধিকার ভোগ করতে পারছে না। তার অন্যতম হচ্ছে সম্পদ-সম্পত্তিতে অধিকারে বৈষম্য। কৃষিকাজের ২৩টি পর্যায়ের ১৭টি ক্ষেত্রে নারী অংশগ্রহণ করছেন, কিন্তু নারী কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন না, কারণ তাঁর জমির মালিকানা নেই। সংবিধানে নারীর সম-অধিকার স্বীকৃত, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে নয়। ফলে ব্যক্তিনারীর জীবনে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ ও দত্তকের ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্য। ব্যক্তি-অধিকারের এই বৈষম্য সমাজে নারীকে অধস্তন করে রাখছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তিনারীর অগ্রসরমাণতার যে চিত্র আমরা দেখতে পাই; তারও একটা নির্দিষ্ট গণ্ডি রয়েছে, যা ব্যক্তিনারী এককভাবে অতিক্রম করতে পারেন না। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে নারীর ব্যক্তি-অধিকার যতক্ষণ না স্বীকৃত হচ্ছে, ব্যক্তিনারী বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর অধিকার আদায় করতে পারবেন না, অবস্থানের পরিবর্তন ঘটবে না। আজ নারীকে তাই বিচ্ছিন্নভাবে নিজের অধিকার বিষয়ে ভাবলে চলবে না, সামগ্রিকভাবে নারী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সব সচেতন নারীকে সংগঠিত হতে হবে। মহিলা পরিষদের ৪৬ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে বলা যায়, সংগঠনের ধারাবাহিক প্রয়াস বাংলাদেশে এক তাৎপর্যপূর্ণ নারী আন্দোলন বিকশিত করছে এবং নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অপরিহার্য করে তুলছে। বৃত্ত ভেঙে সমাজের সব ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নারীর অগ্রগতির যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তা বাস্তবে পরিণত করে নারীকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করার পথ উন্মুক্ত করতে হবে আজকের নারী সংগঠন তথা মহিলা পরিষদকে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর লগ্নে এই উপলব্ধি ও অঙ্গীকার আরও জোরদার করে সংগঠন এগিয়ে যাবে সামনের দিকে, নারী-পুরুষের সম-অধিকারসম্পন্ন মানবিক সমাজ নির্মাণে বাংলাদেশ সফল হবে—এমনটাই সবার প্রত্যাশা। সীমা মোসলেম: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদিকা: বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

No comments

Powered by Blogger.