নারীর জন্য অনিরাপদ বাস!

সম্প্রতি আমি প্রথম আলোয় একটি লেখায় বাসে নারী যাত্রীদের প্রতি পুরুষ যাত্রীদের অভব্য আচরণের কথা তুলে ধরায় বেশ কয়েকজন পাঠক প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁদের দাবি খুব কমসংখ্যক পুরুষ যাত্রী অভব্যতা করেন। বেশির ভাগ পুরুষ যাত্রী নারী যাত্রীদের প্রতি সদয় আচরণই করে থাকেন। তাঁদের এই দাবি সত্য হলে খুশি হতাম। কিন্তু বিভিন্ন জরিপ ও পরিসংখ্যান বিপরীত চিত্রই তুলে ধরে। গত বৃহস্পতিবার তিনটি বেসরকারি সংগঠন আয়োজিত সেমিনারে গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের বিড়ম্বনা নিয়ে মূল নিবন্ধ পেশ করেন ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মারুফ হোসেন। তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, যেসব নারী পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন, তাঁদের ৪৯ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হন। এই গবেষণা থেকে আরও জানা গেছে যে, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের ভয়ে এখন ১৩ শতাংশ নারী বাসে চলাচল করেন না। ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ নারী বাসে চলাচল করেন। ওই সেমিনারে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ-এর আবাসিক পরিচালক ফারাহ কবীর জানান, দেশে ৪৮ শতাংশ নারী যাত্রী বাসের চালক ও ভাড়া আদায়কারীর কাছ থেকে অপমানজনক ভাষা শুনে থাকেন। আমার লেখার প্রতিবাদকারী পাঠকদের বলব, তাঁরা লেখার প্রতিবাদ না করে বাসে নারী যাত্রীদের যাঁরা হয়রানি করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজটি করলে যৌন হয়রানি অনেকটা কমবে। সরকার একদিকে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অসামান্য সাফল্যের ফিরিস্তিও তুলে ধরছে। অন্যদিকে ঘরের বাইরে বের হলেই তাঁদের লাঞ্ছনা ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এটা চরম স্ববিরোধিতা। নারীর ঘরের বাইরে আসার পথে হাজারটা বাধা। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়। এক শ্রেণির ধর্মান্ধ ব্যক্তি তো ফতোয়া দিয়ে যাচ্ছেন যে নারীর বেশি লেখাপড়ার দরকার নেই। সন্তানদের দেখাশোনার জন্য চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেই চলবে। এসব বাধা ও ফতোয়া উপেক্ষা করেই নারীরা বাইরে কাজ করছেন। কিন্তু সেখানেও যদি প্রতিনিয়ত হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাহলে কীভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হবে? প্রথম আলোর পাঠকদের দাবি, বাসে চলাচলকারী খারাপ মানুষের সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো বেশির ভাগ মানুষই সেই কতিপয় খারাপ মানুষের দুর্বৃত্তপনা মুখ বুজে মেনে নিচ্ছেন। কোনো প্রতিবাদ করছেন না। এই প্রতিবাদহীনতাই নারীর অবস্থানকে আরও দুর্বল করছে। তাঁকে চার দেয়ালের ভেতরে বন্দী থাকতে বাধ্য করছে। এসব ফতোয়ার চেয়েও বিপজ্জনক। সম্প্রতি ব্র্যাক পরিচালিত আরেকটি জরিপে দেখা যায়, ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে নারী নির্যাতনের হার ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। ব্র্যাকের নিজস্ব কর্মীদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৭৬ শতাংশ ঘটনা নথিভুক্তই করা হয় না। অর্থাৎ নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও মামলা হয় না। এর কারণ প্রথমত, পারিবারিক ও সামাজিক কারণে তাঁরা প্রতিকার চান না। দ্বিতীয়ত, থানাও মামলা নেওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহী। নারী নির্যাতন বা ফৌজদারি অপরাধের সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা আছে পুলিশ বিভাগে। এই প্রতিবেদন লেখার সময়ই খবর পেলাম, মধুপুরে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী যাত্রী। গত শুক্রবার সকালে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি-মধুপুর সড়কে এ ঘটনা ঘটে। ধর্ষকেরা বাসের চালক ও কর্মচারী এবং তারা ধরাও পড়েছে। ওই বাসে দ্বিতীয় কোনো যাত্রী ছিল না। একজন নারী যদি বাসে নিরাপদে যেতে না পারেন, তাহলে কীভাবে পুরুষ নিজেদের সভ্য বলে দাবি করে? নারীকে নয়, এ ধরনের অসভ্য পুরুষকেই ঘরের ভেতরে বন্দী করে রাখা উচিত। আর সেটি হবে অবশ্যই লাল রঙের ঘর। বাসে-ট্রেনে-রিকশায়-অটোতে—কোথাও নারী যাত্রীরা নিরাপদ নন। দিল্লিতে এক ‘নির্ভয়া’ সারা ভারতের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন। ধর্ষকদের ফাঁসির রায় হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে শত শত নির্ভয়া যে পথে-ঘাটে ধর্ষণ ও নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন, তার কটি বিচার হয়েছে? এই বিচারহীনতাই নারীকে আরও বেশি প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে। তাই, বাংলাদেশেও এই ধর্ষক ও নারী নির্যাতকদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। আর এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে পুরুষদেরই। কতিপয় খারাপ পুরুষের জন্য আমরা গোটা পুরুষ সম্প্রদায়কে কালিমালিপ্ত হতে দিতে পারি না। নারীর জন্য ঘর এবং গণপরিবহন দুটোই নিরাপদ হোক।

No comments

Powered by Blogger.