পদত্যাগ করলেন আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী

আইসল্যান্ডের পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী সিগমন্ডুর ডেভিড গুনলাগসন
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতাসহ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অর্থ পাচার এবং কর ফাঁকির এ কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর গতকাল মঙ্গলবার বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমন্ডুর ডেভিড গুনলাগসন। এর আগে পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে দেশের প্রেসিডেন্টকে আহ্বান জানান তিনি। তবে প্রেসিডেন্ট ওলাফুর র্যা গনার গ্রিমসন তাঁর আহ্বানে সাড়া দেননি। অর্থ পাচারের তালিকায় নাম থাকা ধনশালী ৮০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। তদন্ত শুরু হয়েছে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও পানামায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, রাজনীতিক এবং চলচ্চিত্র ও ক্রীড়া জগতের তারকা ব্যক্তিদের অর্থ পাচারের খবর প্রকাশ হয় গত রোববার। এ ঘটনায় একটি স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি করার ঘোষণা দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কর ফাঁকি দেওয়াকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের কথা জানিয়ে তাঁর দল প্রগ্রেসিভ পার্টির উপনেতা ও কৃষিমন্ত্রী সিগুইডুর ইঙ্গি জোনাসন বলেন, পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের কথা জানিয়েছেন। এখন তিনি (কৃষিমন্ত্রী) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন বলে জানান। মোসাক ফনসেকা নামে পানামার একটি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ১ কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি ফাঁস হয় রোববার। এ ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। নথিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নিকটাত্মীয়দের নাম আসে। এ তালিকায় আরও আছে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ বিন আবদুল রহমান আল সৌদ, মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের এক ছেলে এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দুই ছেলে ও মেয়ের নাম। রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের পাশাপাশি ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি এবং ভারতের চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতিমান অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন এবং তাঁর পুত্রবধূ ও অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়ার নামও অর্থ পাচারকারীদের তালিকায় স্থান পেয়েছে। মোসাক ফনসেকার ওই ১ কোটি ১৫ লাখ নথি অজানা সূত্র থেকে জার্মান দৈনিক জিটডয়েচ সাইতং-এর হাতে আসে। পত্রিকাটি সেসব নথি ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসকে (আইসিআইজে) দেয়। ১৯৭৭ থেকে ২০১৫, প্রায় ৪০ বছরের এসব নথি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার কিছু অংশ আইসিআইজে প্রকাশ করে। গতকাল সকাল থেকে আইসল্যান্ডের রাজধানী রেকজেভিকের পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বিক্ষোভ করে কয়েক হাজার মানুষ। তারা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে। ফাঁস হয়ে যাওয়া নথি অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী সিগমন্ডুর গুনলাগসন ও তাঁর স্ত্রী ২০০৭ সালে উইনট্রাস নামের কোম্পানি কেনেন। ২০০৯ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার সময় গুনলাগসন প্রতিষ্ঠানটি থেকে পাওয়া লভ্যাংশের কথা গোপন করেছিলেন। কেলেঙ্কারির খবর বের হওয়ার পরপরই সোমবার গুনলাগসনের পদত্যাগের দাবিতে গণস্বাক্ষরে সই করে ২৪ হাজার মানুষ। মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে কর ফাঁকি দেওয়া অর্থ কর রেয়াতকারী অঞ্চলে তথাকথিত প্রতিষ্ঠান (অফশোর কোম্পানি) তৈরির মাধ্যমে গচ্ছিত রেখেছিলেন পাচারকারীরা। এসব অঞ্চলের মধ্যে প্রায় সব কটিই যুক্তরাজ্যের রানীশাসিত নানা অঞ্চল (ব্রিটিশ টেরিটোরিজ)। এই অঞ্চলগুলো ‘করের স্বর্গ’ বা ‘ট্যাক্স হেভেন’ নামে পরিচিত। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি নিয়ে তাই গতকাল বিরোধীদের তোপের মুখে পড়েন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবেন বলেন, এ অঞ্চলগুলো যদি যুক্তরাজ্য সরকারের কর নীতি না মানে, তাহলে ‘প্রত্যক্ষ শাসন’ জারি করা হোক। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হওয়ার পর গতকাল প্রথম প্রতিক্রিয়া জানালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি বলেন, কর ফাঁকি দেওয়াটা একটা বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ধনী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো কর আইনের ফাঁকফোকর বের করে অর্থ পাচার করছে। ফ্রান্স ঘোষণা করেছে, তারা এ ঘটনার তদন্ত করবে। গতকাল ফরাসি অর্থমন্ত্রী মিশেল সাপাঁ পার্লামেন্টে ঘোষণা দেন, ফ্রান্স কর ফাঁকি দেওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে যেসব দেশ সহযোগিতা করে না, এর তালিকায় এখন পানামার নাম যুক্ত করবে। অস্ট্রেলিয়ার কর কার্যালয় গতকাল তালিকায় নাম থাকা ৮০০ ব্যক্তির বিষয়ে তদন্তের ঘোষণা দেয়। অস্ট্রিয়ার আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বলেছে, তালিকায় নাম উঠে আসার পর দেশের দুটি ব্যাংক অর্থ পাচারে জড়িত ছিল কি না, তা নিয়ে তারা তদন্ত শুরু করেছে। মোসাক ফনসেকার দেশ পানামাও তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে। আদৌ অর্থ পাচার বা এ জন্য কোনো অপরাধমূলক কাজ হয়েছে কি না, সে লক্ষ্যেই হবে এ তদন্ত। পানামার প্রেসিডেন্ট জুয়ান কার্লোস ভারেলা বলেন, তাঁর সরকার আন্তর্জাতিক যেকোনো তদন্তে সহযোগিতা করতে রাজি। তবে তাঁর দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখেই তিনি সবকিছু করবেন। যে ৫০০ ভারতীয়র নাম তালিকায় উঠে আসে, তাঁদের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর দুদিন পর গতকাল মুখ খোলেন অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন। তিনি বলেন, যে চারটি জাহাজ কোম্পানির পরিচালক হিসেবে তাঁর নাম এসেছে, এগুলো তিনি চেনেন না। এসব প্রতিষ্ঠানে তাঁর নাম ভুলভাবে এসেছে বলে তাঁর ধারণা। তিনি বলেন, ‘আমার প্রদেয় সব কর আমি শোধ করেছি। যেসব অর্থ বিদেশে ব্যয় করেছি, সেসবের করও আমি দিয়েছি।’ অমিতাভের পুত্রবধূ ঐশ্বরিয়া রাইয়ের গণমাধ্যম উপদেষ্টা রাইয়ের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগকে ‘পুরোপুরি মিথ্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পানামা পেপারসে দেশের দুটি ব্যাংকসহ ৬০০ প্রতিষ্ঠানের নাম আছে—গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশ পাওয়ায় ইসরায়েল এসব প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করার ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে এই কেলেঙ্কারিতে যেসব ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে, তাঁদের অনেকেই নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের তিন সহযোগীর নাম উঠে এলে সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ আসে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে। আর গতকাল ক্রেমলিনের মুখপাত্র এই কেলেঙ্কারিতে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনেন। তিনি বলেন, ‘আসলে এর মাধ্যমে রাশিয়ায় একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করাই মূল উদ্দেশ্য।’

No comments

Powered by Blogger.