প্রতিযোগিতা ছাড়া কাজ পাচ্ছে চীনা কোম্পানি by আনোয়ার হোসেন

পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে রেললাইন নির্মাণে একটি চীনা কোম্পানিকে কাজ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ইতিমধ্যে দর-কষাকষি করে প্রায় ২৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয় ঠিক করা হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে চুক্তি সইয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে রেলওয়ে। কাজ শুরুর কথা এ বছরের শেষের দিকে। এই নির্মাণকাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। চায়না রেলওয়ে গ্রুপ (সিআরইসি) নামে একটিমাত্র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে তাদের নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। চীনা ঋণের অর্থে পরিচালিত এই প্রকল্পে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের শর্ত আছে। তবে সে ক্ষেত্রেও একাধিক চীনা ঠিকাদারের কাছ থেকে দরপত্র নিলে প্রতিযোগিতামূলক দর-কষাকষিতে নির্মাণ ব্যয় কমিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি হতো বলে মন্তব্য করেছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। এভাবে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রফা করার বিরোধিতা করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে নালিশও গেছে। অর্থমন্ত্রী গত ২১ মার্চ রেলমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করার অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রকল্পের অধীনে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ হওয়ার কথা। গেন্ডারিয়া থেকে মাওয়া পর্যন্ত অনেক নদী থাকার কারণে এই অংশটুকু উড়াল রেলপথ হবে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হলে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ১৪২ কোটি টাকা। সম্প্রতি শেষ হওয়া টঙ্গী-ভৈরব বাজার পথে নতুন রেললাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ৩৮ কোটি টাকা। সেই কাজটিও করেছে সিআরইসি, তবে তা প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে আরও দুটি অংশে এভাবে রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প চলছে এবং ব্যয় অনেক কম। সিআরইসির আরেকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো প্রকল্পের কাজ করছে। রেলওয়ে ও সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্র বলছে, চীন সরকারেরই বাছাই করা একাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদার নিয়োগ করা হলে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হতো। তখন ব্যয়ও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আর একটিমাত্র ঠিকাদারের বদলে চীনেরই একাধিক ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া গেলে কাজও দ্রুত বাস্তবায়িত হতো। গত বছরের আগস্টে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী গাও হো চেংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠক হয়। সেখানে তাঁরা চীনের অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পগুলো সীমিত দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণ করে বাস্তবায়নে সম্মত হন। সরকারি ক্রয় বিধিমালা ২০০৮-এ নির্দিষ্ট তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করাকে সীমিত দরপত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রেলের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে চীন কয়েকটি যোগ্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাছাই করে দিতে পারত। সেখান থেকে রেলপথ মন্ত্রণালয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এক বা একাধিক ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নিতে পারত। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, একাধিক ঠিকাদার নিয়োগ করতে গেলে সময় অনেক বেশি লেগে যেত। আর সিআরইসির সঙ্গে যে নির্মাণব্যয়ের রফা হয়েছে, তা কোনোভাবেই বেশি নয়। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রেললাইন নির্মাণে সিআরইসি প্রথমে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকার প্রাথমিক প্রস্তাব দিয়েছিল। দর-কষাকষির পর এখন তা ২৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ইতিমধ্যে চীনা কোম্পানির প্রস্তাব সরকারের অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করেছে। পরিকল্পনা কমিশন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদন দিলে এটি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে তোলা হবে। এরপর ঠিকাদারের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি হবে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি মাসে এই প্রকল্প নিয়ে হওয়া এক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী। সেখানে তিনি তৃতীয় কোনো পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যয় যাচাই করার পরামর্শ দেন। জানতে চাইলে জামিলুর রেজা চৌধুরী গত শুক্রবার বলেন, একটিমাত্র প্রস্তাব হওয়ায় কারও মনে হতে পারে ব্যয় কম বা বেশি হলো কি না। এ জন্যই তৃতীয় পক্ষ দিয়ে যাচাই করানো যেতে পারে। তিনি বলেন, প্রকল্পটা চীন-বাংলাদেশের (জিটুজি) মাধ্যমে হবে। সুতরাং, দুই পক্ষ মিলেই একটা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে আসা উচিত। সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী বলেন, চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া প্রস্তাব ব্রিটিশ একজন পরামর্শককে দিয়ে যাচাই করা হচ্ছে। ব্যয় নিয়ে আর প্রশ্ন থাকবে না।

No comments

Powered by Blogger.