বাড়ছে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা by তামান্না মোমিন খান

স্বাদটা বিদঘুটে। ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। প্রথমবার সিগারেটে টান দিলে এমনি লাগে। তারপরও টেনে যাচ্ছিলাম। কারণ, বন্ধুরা টানছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমির ছলে এভাবেই সিগারেট মুখে তোলার অনুভূতির কথা জানান জান্নাতুল ফেরদৌস (ছদ্মনাম)। এরপর থেকে সিগারেট ছাড়া আর আড্ডা জমতো না। সেই যে শুরু এখনও নিয়মিত ধূমপান করে চলেছেন জান্নাতুল। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তিনি বলেন, জানি ধূমপান করলে অনেক ক্ষতি। তারপরও ছাড়তে পারছি না। এক সময় অশিক্ষিত, নিম্নবিত্ত বা শ্রমজীবী নারীদের ধূমপান করতে দেখা যেত। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত নারীদের ধূমপান করতে দেখা যেত না। অথচ এখন নিজেকে আধুনিক প্রমাণ করতে শিক্ষিত নারীদের ধূমপানে আসক্তি বাড়ছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ধূমপান করা খারাপ কিছু- এটা মানতেও তারা নারাজ। বরং প্রকাশ্যে ধূমপান করা তাদের অধিকার বলে মনে করে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ তৃতীয় বর্ষের একজন ছাত্রী বলেন,  ব্যক্তিগত কিছু বিষয়ে হতাশা থেকে ধূমপান শুরু করি। আমি ধূমপান করলে যেহেতু অন্যের ক্ষতি হচ্ছে না, তাই আমার মতে ধূমপান করা খারাপ কিছু না। বাসায় ধূমপানের বিষয়ে কেউ জানে না। তবে মাঝে মাঝে সন্দেহ করে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য এক ছাত্রী বলেন, কাম্পাসের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলে অনেকেই কটুদৃষ্টিতে তাকান। ছেলে মেয়ের সমান অধিকার। একজন ছেলে যেহেতু রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধমূপান করলে কিছু হয় না, কাজেই আমি মনে করি না একটি মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করলে সেটা খারাপ কিছু। তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন বলছে, সম্প্রতি দেশে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। এক সময় কম শিক্ষিত ও দরিদ্রদের মধ্যে ধূমপানের আসক্তি থাকলেও এখন উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরাও ঝুঁকছেন ধূমপানের দিকে। ২০০৯ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) পরিচালিত যৌথ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ শতাংশ পুরুষ এবং ১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপান করে থাকেন। এবং ২১ শতাংশ পুরুষ ও ১ দশমিক ১ শতাংশ নারী বিড়ির মাধ্যমে ধূমপান করে থাকে। তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার তথ্য অনুযায়ী, দেশে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। তবে বর্তমানে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বলে জানান প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের। তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে নারী-পুরুষ ধূমপায়ীর সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু আমাদের দেশে সামাজিকভাবে পুরুষরা ধূমপান করলেও নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা ছিল খুব কম। অথচ এখন নারীরা ধূমপানে আসক্ত হচ্ছে। সিগারেট কোম্পানিগুলো তাদের বাজার বাড়াতে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীদের টার্গেট করে বিভিন্ন ধরনের সিগারেট তৈরি করছে। বিভিন্ন প্রচরণার মাধ্যমে নারীদের ধূমপানে আকৃষ্ট করছে। এতে স্বাস্থ্যগত ক্ষতির দিকগুলো জেনেও নারীরা ধূমপান করছে বলে জানান জুবায়ের। ধূমপান যে কোনো মানুষের জন্যই ক্ষতিকারক।
তবে একজন ধূমপায়ী পুরুষের চেয়ে একজন ধূমপায়ী নারী শারীরিকভাবে বেশি ক্ষতির শিকার হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ধূমপানের ফলে প্রাথমিকভাবে মানুষের শারীরিক অভ্যাসে কিছু পরিবর্তন ঘটে। যেমন, ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন হওয়া, খাবার রুচি কমে যাওয়া, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হওয়া। এছাড়াও ধূমপানে ফুসফুসের ক্যানসার, লাং ক্যানসার, খাদ্যনালীতে ক্যানসার ও মুখে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। নারী ও পুরুষ উভয় ধূমপায়ীর ক্ষেত্রেই এ ধরনের  সমস্যা হতে পারে। এসব সমস্যা ছাড়াও নারী ধূমপায়ীরা স্বাস্থ্যগত দিক থেকে অনেক বেশি ক্ষতির শিকার হন বলে জানান ডা. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী। এগুলো হচ্ছে, ধূমপায়ী নারীদের গর্ভধারণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, গর্ভাবস্থায় পাকস্থলিতে আলসার হওয়া, ধূমপায়ী মায়েদের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করা, সময়ের আগে মেনোপোজ বা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া, হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া, হাড় ভঙ্গুর হওয়া, জরায়ুর ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, বাতজ্বর ও ডিপ্রেশন দেখা দেয়া। চিকিৎসকরা বলছেন, ধূমপানের কারণে নারীদের কর্মক্ষমতাও কমে যায়।

No comments

Powered by Blogger.