ওসির মামলা নেওয়া না–নেওয়া by মিজানুর রহমান খান

গতকালের লেখায় ঢাকার নিকটবর্তী একটি জেলা শহরের কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনার বরাত দিয়েছিলাম। তাঁদের সুরেই বলব, মামলা নিষ্পত্তি করা আর নতুন মামলা হতে না দেওয়া—দুটোকেই সমান গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এই মেধাবী ও কর্তব্যনিষ্ঠ তরুণেরা অন্তত আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। আমরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা নিয়ে খুব মাতামাতি করি। কিন্তু ১৫৪ ধারা নিয়ে একদম চুপ থাকি। অথচ এই ১৫৪ ধারার হাত ধরেই প্রতিদিন হাজারো মামলার জন্ম কিংবা মৃত্যু ঘটছে। এখন বছরে থানাগুলো গড়ে পৌনে দুই লাখ মামলা নেয়। কিন্তু এর প্রায় দ্বিগুণ ফৌজদারি মামলা প্রতিবছর দায়ের হচ্ছে আদালতে। এটা ইঙ্গিতবহ যে, থানার চেয়ে আদালত বেশি জনবান্ধব। গত ১৪ বছরের মধ্যে প্রথম সাত বছরে (২০০২-২০০৮) থানায় দায়ের হওয়া গড় মামলার তুলনায় পরের সাত বছরে (২০০৯-২০১৫) দায়ের হওয়া মামলা গড়ে ৩৯ হাজার বেড়েছে। এর মধ্যে পুলিশ বাদী মামলা কতটা, তা আমরা জানি না। মামলা নেওয়া না–নেওয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করেন ওসি। তাই ওসিদের অধিকতর মর্যাদার আসনে বসানো এবং তাদের জবাবদিহি বৃদ্ধির বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
ফোন করেছিলাম আইন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহ আলমকে। তিনি নিশ্চিত করেন যে আইন কমিশন কখনো ১৫৪ ধারা নিয়ে কাজ করেনি। সাতটি থানায় ওসি হিসেবে অন্তত আট বছর কাজ করছেন এমন একজন কর্মকর্তা আমাকে বলেন, ১৫৪ ধারার বিষয়ে কোনো গাইডলাইন নেই। কোর্টের কোনো নির্দেশনা নেই। তবে উপরওয়ালারা সাধারণভাবে আমাদের মামলা নিতেই উৎসাহিত করেন। ব্যস্ত থানাগুলোতে বছরে গড়ে প্রায় এক হাজার মামলা নেওয়া হয়। তিনি চমকপ্রদ তথ্য দেন যে, এর কয়েক গুণ মামলা এড়ানো হয়। কারণ, ওসিরা অলিখিতভাবে সালিসকারের ভূমিকা পালন করেন।
আমরা সুপারিশ করব যে একে সমস্যা হিসেবে না দেখে সম্ভাবনা হিসেবে দেখা। ওসিদের আমরা দায়িত্বশীল সামাজিক বিচারক হিসেবে ভাবতে পারি কি না। তারা ক্ষমতা প্রয়োগে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে বাধ্যতামূলক সলাপরামর্শ করবেন। পুলিশ কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছে, কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাঁকে বাঁচাতে হবে। পুলিশকে রুগ্ণ রেখে স্বাস্থ্যবান ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা আমি কল্পনা করতে অপারগ। আমরা চাই বা না চাই, দেশে ওসিদের ঘিরে একটা সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে। আবার ওসিদের যা ক্ষমতা ও এখতিয়ার, তা আইনগতভাবেই আধা বিচারক বা বিচারকের মতোই। আমি সম্প্রতি র্যাবের একজন পদস্থ কর্মকর্তার টেবিলে কাচের নিচে লেখা দেখলাম, ‘টাকাপয়সা, জমিজমা বা ফ্ল্যাট উদ্ধারে অনুরোধ করবেন না।’ পুলিশও এসবে সহজে জড়াতে চায় না। কিন্তু সেই কাজেই বেশি মানুষ প্রতিকার খোঁজেন। আর ২৯ লাখ মামলার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়া আদালতে প্রতিবছর আদালতে প্রায় ১০ লাখ নতুন মামলা ঢুকছে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলাই (মূলত জমি) প্রায় সাত লাখ।
রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, তারা নিজেরা বাদী হয়ে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করবে না। আবার নিরীহ বা ভুক্তভোগী যদি প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে মামলা করতে আসেন, তাহলে তারা মামলা নেবে। ঢাকার ওই ওসি সাহেবকে বললাম, ১৫৪ ধারার ক্ষমতায় একটা ভারসাম্য আনা দরকার। তিনি বললেন, সেটা তো আইনে আছে। বললেন, মিথ্যা মামলার সন্দেহ হলে আমরা ১৫৭ ধারামতে অনুসন্ধান করি, তারপর মামলা নেই। ওসিরা যদি সারা দেশে এই ধারণায় চলেন, তাহলে আইন মার খাচ্ছে। থানার চেয়ে আদালতে দ্বিগুণ ফৌজদারি মামলা দায়েরের এটাই কি বড় কারণ? থানা জনবান্ধব হলে ঘটনাটি ঠিক উল্টো হওয়ার কথা। আমলযোগ্য ঘটনা ঘটলে মামলা দায়েরের সময় তার সত্য-মিথ্যা দেখা ওসির কাজ নয়। সম্প্রতি নির্যাতিত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তার মামলা নিয়ে রাষ্ট্র যে আচরণ করেছে, তা দেশবাসীকে পীড়িত করেছে। হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের পরেও রাষ্ট্র আপিল বিভাগে ছুটেছে। রাষ্ট্র দুঃখজনক আচরণের দ্বিতীয় লিমন উপাখ্যান তৈরি করেছে। সংস্কারের নয়, এটা রাষ্ট্রের আচরণগত সংকট।
গতকাল যে পুলিশ কর্মকর্তাদের কথা বলেছি, তঁারা আমাকে একটা মাদক মামলার ডকেট দেখিয়েছেন। যখন বিচার শুরু হয় তখন দেখা যায় সাক্ষীর অভাব। কারণ, ডকেটে সাক্ষীদের কারও ঠিকানা উল্লেখ থাকে না। আবার সাক্ষীর বলার সুযোগ থাকে, স্যার, আমি তো এ মামলার কিছুই জানি না। যে সাব-ইন্সপেক্টর, তাঁর নাম সাক্ষী হিসেবে ঢুকিয়েছিলেন, তাঁর জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। তাঁর দেওয়া চার্জশিটে অপরাধীর সাজা হলে এসআই পুরস্কৃত হন না। খারিজ হলেও তিরস্কৃত হন না।
ওই কর্মকর্তারা বলেন, আপনি সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করুন, তাঁরা বলবেন, ওসি সাহেব মামলা নেননি বা নিলেও মিথ্যা মামলা নিয়েছেন। তাঁকে অপবাদ থেকে মুক্তি দিন। জবাবদিহির আওতায় আনুন। যদি কোনো লোক থানায় এসে বলেন, মামলা নিন। তাহলে ওসি সাহেবকে একটি ফরম পূরণ করতে হবে। তাঁকে কারণ দেখাতে হবে যে কী কারণে তিনি মামলাটি নিলেন বা নিলেন না। মামলা না নিলে অসন্তুষ্ট ব্যক্তি আদালতে কিংবা অন্য যেকোনো ফোরামে যাবেন। আমজনতাকে বুঝতে হবে, টাকা পাননি বলেই কি ওসি সাহেব মামলা নিলেন না? নাকি মামলাটি নেওয়ারই যোগ্য ছিল না? তখন কিন্তু ওসির সই করা কারণসংবলিত বিবৃতির সত্যতা যাচাইয়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। আর তখন ওসি তাঁর অসীম ক্ষমতা ভোগ করবেন ভেবেচিন্তে। আমি পরে তাদের ওই ফরম পূরণের সুপারিশের সঙ্গে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার মিল দেখে অবাক হই। সেটা বলেই শেষ করব।
প্রসঙ্গক্রমে তাঁরা আরও বলেন, আপনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেদার ছাপিয়ে দেন। অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কিন্তু সেখানে সই থাকে না। তাহলে কী করে তাঁর দায়বদ্ধতা তৈরি হবে? আমি উদ্বেগের সঙ্গে ভাবি, কত হেলাফেলা, তাহলে কত যান্ত্রিকভাবে চলছে গ্রেপ্তার, জামিনের বিরোধিতা ও রিমান্ড প্রার্থনা। বললাম, আইন বলছে, ওসিরা চাইলে জামিন দিতে পারেন। তাঁরা বললেন, আমরা জানি। তবে এর উত্তর পুলিশ হিসেবে দেব না। বাস্তবে এর প্র্যাকটিস আছে এবং তা সব থেকে বেশি। আমার চোখ ছানাবড়া হলো। কারণ, আমি এমন কথা আর শুনিনি। বলি কী করে বলুন তো? তাঁরা বলেন, ধরুন, আমি একটা লোককে থানায় আনলাম। ৫৪ ধারায় আমরা যে কাউকে আনতে পারি। জাফর ইকবাল স্যার লিখেছিলেন, আপনি কীভাবে বুঝলেন, আমার চেহারায় সন্দেহজনক কিছু আছে? তো আমি যাকে আনলাম, তাকে ছেড়েও দিতে পারি। আবার কোনো অন্যায্য সুবিধা নিয়ে আমি তাকে ছাড়তেও পারি। আবার তদবিরের ফোনেও ছেড়ে দিই। জামিন বলি না। ধরি আর ছাড়ি। ছাড়ি আর ধরি। বললাম, ওসিকে তাহলে সীমিতভাবে জামিনের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেওয়া হোক। তাহলে আদালতের ওপর চাপ কমবে। তাঁরা বাধা দিলেন। বললেন, আপনি প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়বেন। কারণ, আস্থার জায়গা নষ্ট হয়ে গেছে।
নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতনরে শিকার।
এটা দ্রুত নিরাময়যোগ্য নয়। তবে ডিসি-এসপির কাছে এখন যেভাবে শুধু রায়সংক্রান্ত তথ্য যায় সেটা যথেষ্ট নয়। প্রতিটি মামলার জামিন, হাজতবাস ও দণ্ড-সংক্রান্ত ডেটাবেইস (যেমন সিঙ্গাপুরে আছে) দ্রুত সৃষ্টি করা সম্ভব। ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞ পল ডি হার্ট ও লুক ভনদামার লেখা ২০০৪ সালের একটি গবেষণাপত্র (ইউরোপিয়ান পুলিশ অ্যান্ড জুডিশিয়াল ইনফরমেশন শেয়ারিং কো-অপারেশন) বলেছে, এমনটাই হতে হবে বৈশ্বিক প্রবণতা। সারা দেশে সিজিএম (মুখ্য বিচারিক হাকিম) সাহেবরা প্রতি মাসে এখন ক্রাইম কনফারেন্স ডাকছেন। সেখানে পুলিশের কেউ কেউ ‘৯০ ভাগ’ ক্ষেত্রে রিমান্ড মঞ্জুরের আকুলতা ব্যক্ত করেন।
ভজন লাল মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, মিথ্যা তথ্য কি না, তা ওসি দেখবেন না। অর্থাৎ ব্যাংক কর্মকর্তা রাব্বীর অভিযোগের মতো হলে ওসি দ্রুত মামলা নেবেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন হাইকোর্ট থেকে এর উল্টো মতও পাচ্ছিলেন। এরপর ললিতা কুমারী বনাম উত্তর প্রদেশ মামলায় বিচার্য হলো, ওসি কি শোনামাত্রই মামলা নেবেন, নাকি একটা প্রাথমিক তদন্ত সেরে নেবেন?
বিচারপতি পিভি রেড্ডির নেতৃত্বাধীন ভারতের আইন কমিশন ২০১২ সালের রিপোর্টে বলেছিল, ১৫৪ ধারা পরিষ্কার নয় বলে বিষয়টি বৃহত্তর বেঞ্চে গেছে। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে আট দফা গাইডলাইন চূড়ান্ত করেন, আমাদের ওসিদের তা অনুসরণ করা উচিত মনে করি। তাতে বলা আছে, আমলযোগ্য অপরাধের বিবরণ থাকলেই হলো। ওসি মামলা নিতে বাধ্য। দাবি করা তথ্য যদি আমলযোগ্য না হয়, তাহলেই পুলিশ প্রাথমিক তদন্ত করবে। এরপরও মামলা না নিতে পারলে তা এজাহার করতে আসা ব্যক্তিকে এক সপ্তাহের মধ্যে জানাতে হবে। এ রকম গাইডলাইন চালু থাকলে রাব্বী–উপাখ্যানের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.