এখনও মসলিনের সম্ভাবনা আছে -সিপিডির সেমিনার

হারিয়ে যাওয়া মসলিন পোশাক শিল্প আবারও ফিরে আসছে। এক সময়ের জনপ্রিয় কারুকাজখচিত শিল্পটি দীর্ঘদিন অনুপস্থিত। সমপ্রতি বাংলাদেশে দুটি মসলিন শাড়ি তৈরি করার পর ফের ফিরে পাচ্ছে মসলিন ঐতিহ্য। একটি শাড়ি তৈরি করা হয় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে। অপরটি গাজীপুরে। ইতিমধ্যে শাড়ি দুটি বাজারজাতসহ মসলিন শিল্প পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরে মাসব্যাপী মসলিন ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়েছে। মসলিন ফিরে আসার খবর জানাতে দফায় দফায় করা হচ্ছে সভা-সেমিনার। গতকাল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির সঞ্চালনায় জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত হয় একটি সেমিনার। সিপিডির সিনিয়র নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমানের পরিচালনায় সেমিনারে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তা ও বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। মসলিনের বাজার সীমিত হলেও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা মন্দ নয় বলে জানান গবেষকরা। ঢাকার ঐতিহ্যের কথা আসলেই মসলিন কাপড়ের নাম সবার আগে আসে। এখন থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে ঢাকার মসলিনের কদর ছিল বিশ্বব্যাপী। মসলিনের প্রসঙ্গ উঠলে তার সঙ্গে অনেক গল্পও সামনে আসে। জনশ্রুতি আছে যে একটি মসলিন শাড়িকে দিয়াশলাইয়ের বাক্সে রাখা সম্ভব। যদিও বাস্তবে কোনো প্রমাণ মেলে না। দিয়াশলাইয়ের বাক্সে রাখা সম্ভব না হলেও, মসলিনের কাপড়ের সূক্ষ্মতা ও হালকা আরামদায়কভাব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। মসলিন বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত ৩০০ বছর আগে। মসলিনের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে ঢাকায় চলছে ৩০ দিনের মসলিন উৎসব। দৃক গ্যালারি, আড়ং ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মাসব্যাপী উৎসবটি শুরু হয় গত শুক্রবার। মসলিন বিষয়ে গবেষক ও দৃক গ্যালারির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, মসলিন শুধু একটি কাপড় নয়, এটিকে দেখতে হবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। তিনি বলেন, আমরা তো প্রতিদিন মোটা চালের ভাত খাই। তাই বলে তো বাসমতি ফেলে দেইনি। সে হিসেবে একটি স্পেশাল জিনিস ফেলে দেয়া উচিত না। মসলিনের অংশ হিসেবে এখনও পর্যন্ত টিকে আছে জামদানি শাড়ি। মসলিনের দাপট এক সময় ইউরোপের বাজারে থাকলেও, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পরে মসলিন আর টিকে থাকতে পারেনি। কারণ ইউরোপ জুড়ে তখন বস্ত্রশিল্প প্রসার লাভ করায় মসলিন বাজার হারিয়েছিল। তাছাড়া, যে তুলা থেকে মসলিনের সুতা উৎপাদন হতো, সে তুলার বীজও এখন আর নেই। মসলিনের একটা বিশেষ বাজার রয়েছে বলে আয়োজকরা মনে করছেন। তারা বলছেন, মসলিন কাপড় এখনও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়। উৎসবে আসা একজন কারিগর জানালেন, আগের মসলিনে হয়তো পুরোপুরি যাওয়া সম্ভব না হলেও কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। উৎসব দেখতে অনেক দর্শক আসেন জাতীয় জাদুঘরে। একজন সৌখিন দর্শক সুমাইয়া আক্তার সারা বলেন, মসলিন উচ্চবিত্তদের কাপড়। আগের দিনের রাজা-বাদশারাই পরতেন। এখনও যারা সৌখিন তারাই এটা পরবে। এটা সাধারণ মানুষের কাপড় নয়। আমি এসেছি দেখতে। ছোট বেলায় শুনেছি-মসলিন কাপড় দিয়াশলাইয়ের বাক্সে বন্দি করা যায়। অবিশ্বাস্য মনে হতো উল্লেখ করে বিবিএ পড়ুয়া সারা বলেন, সেটা রূপকথার গল্প ছিল। তবে এটা সত্য যে, মসলিনের কাপড় স্বাভাবিকের তুলনায় মসৃণ ও সরু।
গবেষক সাইফুল ইসলাম অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ভারতের একটি গ্রাম মসলিনের নামে বছরে ২৫ কোটি টাকার কাপড় বিক্রি করছে। ভারত খাদি মসলিন হিসেবে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। কিন্তু এগুলোকে সব বলা হয় বেঙ্গল মসলিন। তাহলে নিশ্চয়ই মসলিনের বাজার আছে। তাছাড়া, মসলিন ও জামদানি গুণে-মানে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। মসৃণ সুতোর গাঁথুনিই মসলিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ড. হামিদা হোসেন বলেন, বাংলাদেশের সোনারগাঁয়ের মসলিন ও জামদানি শাড়ি খুবই জনপ্রিয়। শিল্পটি হারিয়ে গেলেও আবার ফিরে আসছে, এটি নিশ্চয় আনন্দের খবর। মসলিন ও জামদানির ডিজাইনের প্রশংসা করে ড. হামিদা বলেন, পণ্য দুটির ডিজাইনের মান আন্তর্জাতিক ও ব্যতিক্রম।
সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, ইউনেস্কোর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বিটট্রিক কালডুন, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান, সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, অতিরিক্ত সচিব জামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান এরশাদ হোসাইন, উইমেন ইউনিভার্সিটি ভিসি ড. পারভিন প্রমুখ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ড মিউজিয়ামের সিনিয়র কিউরেটর রোজমেরি ক্রিল। রোজমেরি ক্রিলের ডকুমেন্টারি বর্ণনায় উঠে আসে মুঘল আমলের রাজা-বাদশাদের গায়ে কিভাবে শোভা পেতো মসলিন কাপড়ে তৈরি নানান পোশাক।

No comments

Powered by Blogger.