বাইরে কলঙ্কমোচন আর ভেতরে কালিমালেপন! by মলয় ভৌমিক

ছবিটি ছাপা হয়েছে ২২ নভেম্বর প্রথম আলোর বিশাল বাংলা পাতায়। সাদা-কালোয় চার কলামজুড়ে প্রকাশিত ওই ছবিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতরের চেহারাটা ধরা পড়ে।
কী আছে ছবিতে? যাঁরা দেখেননি, তাঁদের উদ্দেশে ছবির বিষয়বস্তু তুলে ধরছি। নাটোর শহরের জিরো পয়েন্টের সড়কদ্বীপে সরকারি উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ। এতে রয়েছে নাটোর অঞ্চলের শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা। রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছবিসংবলিত বিলবোর্ড-পোস্টারে গোটা চত্বরটি এমনভাবে ঢেকে ফেলা হয়েছে যে ভেতরের স্মৃতিস্তম্ভটির কোনো নিশানাই বাইরে থেকে আর অনুমান করা যায় না।
বিলবোর্ড আর পোস্টারগুলো দেখে বোঝা যায়, ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই কাজটি করেছেন। সবার জানা যে যেদিন ওই ছবি ছাপা হয়েছে, অর্থাৎ ২২ নভেম্বর প্রথম প্রহরেই কার্যকর হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি। প্রত্যাশিত রায় কার্যকর হওয়ায় দেশবাসী সেদিন স্বস্তি প্রকাশ করেছে এবং আওয়ামী লীগসহ অনেক রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা রাস্তায় নেমে বিজয় মিছিল করেছেন। আমরা নিশ্চিত যে যেসব নেতা ব্যক্তিগত অভিলাষ পূরণের জন্য নাটোরের জিরো পয়েন্টে বিলবোর্ড-ব্যানার ঝুলিয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ ঢেকে ফেলেছেন, সেসব নেতাও সেদিন রাস্তায় নেমেছিলেন। অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস ও আদর্শের বৈপরীত্যের এই চিত্র কেবল নাটোর নয়, সারা দেশের নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রেই কম-বেশি দৃশ্যমান।
প্রকাশিত ছবিতে আরও একটি চরম পরিহাসের নমুনা লক্ষ করা যায়। শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ ঢেকে ফেলা একটি বড় ব্যানারে লেখা আছে ‘শহীদদের মৃত্যু নেই’। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে বীর শহীদদের প্রতি কেবল লোকদেখানো শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নয়, প্রজন্মপরম্পরায় শহীদদের বীরত্বগাথা তুলে ধরার জন্য। সেই স্মৃতিস্তম্ভ যদি ঢেকেই রাখা হয়, তাহলে শহীদদের বীরত্ব মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে কীভাবে? এ ক্ষেত্রে ‘শহীদদের মৃত্যু নেই’—এই বাণী দিয়ে শহীদদের প্রতি পরিহাস করা হলো নাকি?
স্মৃতিস্তম্ভ ঢেকে ফেলা ব্যানার-পোস্টারে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক পৌরসভা নির্বাচনের জন্য দোয়া-শুভেচ্ছা চাওয়ার বিষয়টি চিত্রিত হয়েছে। আগস্টের পোস্টার থেকে বোঝা যায়, কমপক্ষে চার মাস আগে ঢাকা পড়েছে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি। জিরো পয়েন্টের সড়কদ্বীপ নাটোরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। এর পাশ দিয়েই গেছে ঢাকা ও বগুড়া-রংপুর মহাসড়ক। এই চার মাসে এসব সড়ক দিয়ে নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই যাতায়াত করেছেন। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ঢেকে ফেলার ঘটনাটি তাঁদের চোখে পড়েনি—এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। এমনও হতে পারে, ওই সড়কদ্বীপে তাঁদের আগমনকে কেন্দ্র করে ‘শুভেচ্ছা-স্বাগতম’ গোছের ব্যানার দেখে তাঁরা বরং খুশিই হয়েছেন। সব নেতা-কর্মীর ক্ষেত্রে এ কথা হয়তো প্রযোজ্য নয়, কিন্তু আজকের গড় চিত্রটা এমনই। স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী বা নাগরিক সমাজও কিন্তু এ ব্যাপারে ছিল নির্বিকার। আসলে ব্যক্তি আকাঙ্ক্ষা, ভোগ-লোভ-দুর্নীতি ইত্যাদি আজ আদর্শ ও দেশপ্রেমকে ছাপিয়ে দৃষ্টিকটুভাবে সামনে চলে এসেছে। ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে এমন লোকজন ঢুকে পড়েছে যে চারদিকে তাকালে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আজ বড়ই অচেনা মনে হয়।
সব থেকে ভয়াবহ হলো, পূর্বসূরিদের এই বিচ্যুতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে উত্তরসূরিরা। বাইরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ভেতরে কালিমালেপনের মতো আরেকটি ঘটনার খবর ছাপা হয়েছে আলোচ্য ছবিটি প্রকাশের ঠিক পরদিনই। ২৩ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত ওই খবর থেকে জানা যায়, আগের দিন শহীদ হবিবর রহমান হল মাঠে ছাত্রলীগের হল সম্মেলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক খালিদ হাসান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ছাত্রশিবিরকে প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারটি দৃঢ় হাতে মোকাবিলার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন। এর কিছু সময় পরই কাজলা গেটে একদল দুর্বৃত্ত তাঁর ওপর ককটেল নিক্ষেপ করে। খালিদ হাসানের বক্তব্য ও তাঁর ওপর হামলার ঘটনা থেকে দুটি সত্য বেরিয়ে এসেছে। প্রথমত, ছাত্রলীগে যে শিবির প্রশ্রয় পাচ্ছে, এই সত্যটি খালিদ হাসান স্বীকার করেছেন। দ্বিতীয়ত, প্রশ্রয় পাওয়া শিবিরের কর্মীদের প্রভাব সেখানে এত বেশি যে তাঁরা খোদ ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদককে আক্রমণ করতেও দ্বিধা করছেন না। এ কথা প্রচলিত যে নানাভাবে বিভক্ত উপদলীয় নেতারা নিজেদের দল ভারী করতে ছাত্রশিবিরকে দলে ভেড়াচ্ছেন। পাশাপাশি এ কথাও প্রচলিত যে এই প্রক্রিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে কোণঠাসা শিবিরের কর্মীদের কাছ থেকে মাসোয়ারা আদায় করছেন একশ্রেণির ছাত্রনেতারা। আমরা এ ব্যাপারেও একমত হতে পারি যে এই কালিমা নিয়েই সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির পর ২২ নভেম্বর ক্যাম্পাসে কলঙ্কমোচনের মিছিল করা হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের পেছনে রয়েছে একটি বধ্যভূমি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় জোহা হল ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। প্রতিদিন এই ক্যাম্পে শত শত নিরপরাধ বাঙালিকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। এরপর জোহা হলের পেছনের বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রাখা হতো লাশগুলো। মনে করা হয়, এটিই বাংলাদেশের সব থেকে বড় গণকবর। কয়েক বছর আগে এই স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। স্তম্ভের স্থানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চত্বর থেকে বিচ্ছিন্ন ও নিরিবিলি। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে একজন প্রবাসী বাঙালিকে স্থানটি দেখানোর জন্য আমি স্মৃতিস্তম্ভে নিয়ে যাই। স্তম্ভের বেদিতে জুতা পায়ে উঠে আড্ডায় মেতে থাকতে দেখা যায় অন্তত এক ডজন তরুণ-তরুণীকে। স্মৃতিস্তম্ভের পাশে পুলিশের দুজন কনস্টেবল দায়িত্বরত ছিলেন। বিষয়টি নজরে আনলে কনস্টেবলরা তাঁদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। তাঁরা জানান, এঁরা নিজেদের ছাত্রলীগ হিসেবে পরিচয় দিয়ে উল্টো চোটপাট দেখান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও নাকি বিষয়টি অবগত করেছেন তাঁরা। ফল হয়নি। ঘটনাটি আমি ওই দিনই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক খালিদ হাসানকে জানাই। যথারীতি বিষয়টি দেখার আশ্বাসও দেন তিনি। কিন্তু এতে অবস্থার হেরফের হবে বলে মনে হয় না। কেননা, তিনি নিজেই দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত।
আমার বিশ্বাস, কেবল ছাত্রলীগের কর্মীরাই এমনটি ঘটান, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানেও তরুণদের মধ্যে আগের মতো সেই চেতনা আজ আর কাজ করে না। মুক্তমনা লোকদের একের পর এক হত্যার ঘটনার পরও চোখে পড়ে না সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে কোনো প্রতিবাদ। বরং এর পরিবর্তে নানা অপপ্রচারের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায় অনেককেই। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে যখন মিথ্যা গুজব ছড়ানো এবং সেই গুজবে বিশ্বাস করার লোকের অভাব হয় না, তখন সাধারণের অবস্থাটা অনুমান করা যায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও উচ্চশিক্ষার মান যে প্রশ্নবিদ্ধ, তাতে আর সন্দেহ কী।
আসলে দোষ আমাদের তরুণ ছাত্রসমাজের নয়, আমরা শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরা, রাজনীতিবিদেরা, ক্ষমতার ভাগ নিয়ে নানা স্থানে জেঁকে বসা মানুষেরা নিজেদের কৃতকর্ম দ্বারাই তাঁদের বিপথে পরিচালিত করে চলেছি। সাম্প্রতিক সময়ে আমি বেশ কয়েকবার রাজশাহী রেলস্টেশনে ছাত্রলীগের শত শত কর্মীকে ট্রেন থেকে নেমে আসা একজন স্থানীয় নেতার পেছনে ‘অমুক ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’ বলে স্লোগান দিতে দেখেছি। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ভালোবাসা থেকে ছাত্ররা সেখানে যাননি, গেছেন নির্দেশিত হয়ে। অর্থাৎ, এখন কোনো ছাত্রসংগঠনের নেতা হওয়ার প্রধান যোগ্যতাই হয়েছে ওপরের নেতাদের তোয়াজ করা এবং তাঁদের বন্দনাগীত গাওয়া।
এই ১৫ নভেম্বর কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে মুঠোফোনে হুমকি দেওয়া হয়। ঘটনার পরদিন কেবল ছাত্র ইউনিয়ন হাতে গোনা কয়েকজন কর্মী নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদ জানিয়েছিল। শিক্ষক সমিতি দিয়েছিল একটি বিবৃতি। অন্য কোনো কর্মসূচি তারা দেয়নি। ছাত্রলীগসহ অনেকেই রাস্তায় নামেনি। আমি ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনেছি, তারা হল সম্মেলন নিয়ে ‘ব্যস্ত’ ছিল। হাসান আজিজুল হক একসময় যে সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ছিলেন, সেই জোটকে রাস্তায় নামাতে সময় লেগেছিল তিন দিন। তা-ও মাত্র শ খানেক কর্মী সমবেত হয়েছিলেন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে। গত কয়েক বছরে এই কথাশিল্পীকে অতিথি করে যে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান-সংগঠন নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে, তাদের কাউকেই ঘটনার পর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা জানি, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে হুমকি দেওয়ার পরের চিত্রও ছিল প্রায় একই।
সামগ্রিক এই অবস্থা থেকে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভবিষ্যৎটা সহজেই আঁচ করা যায়।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।

No comments

Powered by Blogger.