রক্তাক্ত হামলায় গ্রামবাসী জানল শিয়া-সুন্নি ভেদ! by গোলাম মর্তুজা

বগুড়ার শিবগঞ্জের চাককানু গ্রামের শিয়া মসজিদের সামনে
গতকাল সতর্ক অবস্থায় পুলিশ। এই মসজিদেই গত
বৃহস্পতিবার অস্ত্রধারীদের হামলায় মুয়াজ্জিন নিহত ও
ইমামসহ অপর তিনজন গুরুতর আহত হন l ছবি: এএফপি
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর, চককানুসহ আশপাশের ছয়টি গ্রামে দেড় শ ঘর শিয়া মুসলমানের বাস। এদের কেউই বংশানুক্রমিকভাবে শিয়া নয়, গত তিন দশকে শিয়া মতবাদ গ্রহণ করেছে। এক পরিবারেরই এক ভাই শিয়া আর অন্যরা সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী। গ্রামগুলোর অনেক তরুণ জানেনই না শিয়া-সুন্নির তফাতটা কী। জানেন কেবল একদল হাত বেঁধে, আরেক দল হাত ছেড়ে নামাজ আদায় করে।
এই দুই মতবাদের মানুষের মধ্যে কখনো কোনো বিরোধ হয়নি। মানুষের প্রাণ নিয়ে কারা এই শান্ত গ্রামগুলোতে শিয়া-সুন্নি বিরোধের বীজ বপন করতে চায়, তা-ই এখন বড় জিজ্ঞাসা এখানকার মানুষের।
বগুড়ার মোকামতলা-জয়পুরহাট আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপরে ২০-২২টি দোকান নিয়ে হরিপুর বাজার বাসস্ট্যান্ড। মহাসড়কের উত্তর পাশে হরিপুর আর দক্ষিণ পাশে চককানু গ্রাম। চককানু গ্রামের শিয়া মসজিদেই গত বৃহস্পতিবার মাগরিবের নামাজের পর পর অস্ত্রধারীরা হামলা করে। এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও তিনজন।
মূলত সবজি চাষ ও এর ব্যবসা করে দুই গ্রামের মানুষই মোটামুটি সচ্ছল। মহাসড়ক থেকে নেমে দক্ষিণে মেঠোপথ ধরে গেলে রাস্তার দুই পাশে কয়েকটি বাড়ি। হাতে গুনে চারটি বাড়ি পার হয়ে ডানে দুই বাড়ির মাঝে আড়াই থেকে তিন ফুট প্রস্থের সরু একটি গলি। এলাকাটা না চিনলে ওই গলির অস্তিত্ব বোঝাও দায়। গলি ধরে সামনে গেলে হলুদ রঙের লোহার গ্রিলের দরজা। এরপর এক চিলতে আঙিনা পার হলে মসজিদে ঢোকার দরজা। বাঁয়ে অজুখানা ও বাথরুম এবং নির্মাণাধীন সীমানা দেয়াল।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বন্দুকধারীরা ঢুকে গ্রিলের দরজাটি ভেতর থেকে বন্ধ করে মসজিদের সামনে আঙিনায় দাঁড়িয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েছিল।
এই শিয়া মসজিদটির বিষয়ে স্থানীয় শিয়া সম্প্রদায় ও মসজিদের আশপাশের গ্রামের লোক ছাড়া অন্যরা জানতেনই না। শিয়া মসজিদটি যে চককানু গ্রামে অবস্থিত সেই আটমূল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মান্নান প্রথম আলোকে বললেন, এই ইউনিয়নে যে শিয়াদের জন্য পৃথক একটি মসজিদ আছে সেটিই তিনি এর আগে জানতেন না। আর শিয়া-সুন্নি বিরোধের তো প্রশ্নই ওঠে না।
শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের সংগঠন ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবু জাফর মণ্ডল বলেন, ১৯৮০ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধের পরে আয়াতুল্লাহ খোমেনির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ঢাকায় ইরান দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। দূতাবাসের সহায়তায় তিনি ১৯৮৪ সালে হরিপুর গ্রামে ইমামিয়া স্টাডি সেন্টার নামে একটি পাঠাগার চালু করেন। নিজে শিয়া মতবাদ গ্রহণ করেন। তাঁর দেখাদেখি ৩১ বছরে ছয় গ্রামে দেড় শ পরিবার শিয়া মতবাদ গ্রহণ করে। লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পরে পাঠাগারের কাজের পরিধি বেড়ে যায়। ইমামবাড়া স্থাপন করা হয়। এরপরে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধন করে সংগঠনটির নাম দেওয়া হয় ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানুষের দান করা ৬ শতক জমি, চাঁদা ও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ২০০৯ সালে শিয়া মসজিদটি স্থাপিত হয়। এখনো এর কাজ শেষ হয়নি।
আবু জাফর বলেন, ওই মসজিদে শিয়া ছাড়াও প্রায়ই সুন্নি মতাবলম্বীরাও নামাজ পড়তে আসেন। শিয়ারা হাত ছেড়ে দিয়ে নামাজ পড়লেও সুন্নিরা হাত বেঁধেই তাঁদের সঙ্গে নামাজ পড়েন।
মসজিদের পাশের বাড়ি রেহানা বেগমের। দরজায় দাঁড়িয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যখন তিনি মালয়েশিয়াপ্রবাসী ছেলের কথা ভাবছিলেন তখনই হঠাৎ পর পর অনেকগুলো শব্দ শুনেন। ঘরে ছুটে যান রেহানা। তখনই মসজিদ থেকে চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ আসতে থাকে ‘মইরা গেনু বারে, মইরা গেনু’ (মেরে গেলোরে বাবা, মেরে গেল)। দরজায় শিকলটি আটকে মসজিদের দিকে দৌড়ে গিয়ে দেখেন ভেতরে রক্তারক্তি কাণ্ড। তাঁর মতো আশপাশের বাড়ির অনেকে সাহায্য করতে ছুটে আসেন।
রেহানার বাসা থেকে বের হয়ে কয়েক পা এগোতেই দেখা যায় মসজিদের সামনে সকালের রোদ গায়ে লাগিয়ে জটলা করে আছে কিছু মানুষ। কাছে গিয়ে দেখা গেল, চায়ের দোকানে বসে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক কিশোর একটি স্থানীয় দৈনিকে শিয়া মসজিদে হামলার খবরটি জোরে জোরে পড়ছে। তাকে ঘিরে আরও ১০-১১ জন শিশু-তরুণ, একজন বৃদ্ধ ও কয়েকজন নারী মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। কথা বললে এঁদের কেউই শিয়া-সুন্নির তফাতের বিষয়টি বোঝেন না বলে জানালেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটি বললেন, ‘ওরা (শিয়ারা) হাত ছাইড়ে দিয়ে নামাজ পড়ে, শবে বরাত মানে না—এগুলাই আর কী।’
হামলার পরে গতকাল শিয়াদের ওই মসজিদে জুমার নামাজ হয়নি। র্যা ব-পুলিশ মসজিদের ভেতরটা অপরাধস্থল হিসেবে সংরক্ষণ করছে। শিয়ারা ইমামবাড়ায় জড়ো হয়ে নামাজ পড়েন। সুন্নিরা পড়েন পাশেরই আরেকটি মসজিদে।
নামাজের পরে উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরা হরিপুর বাজারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন নিহত মোয়াজ্জেম হোসেনের লাশের জন্য। বেলা তিনটার দিকে সাদা অ্যাম্বুলেন্সে নীল পলিথিন মুড়িয়ে মোয়াজ্জেম হোসেনের লাশ আসে। অ্যাম্বুলেন্সটি বাজারে না থেমে মোয়াজ্জেমের বাড়ির দিকে যেতে থাকে। পেছনে দৌড়াতে থাকে মানুষ। মেঠোপথ দিয়ে হেঁটেও মোয়াজ্জেমের বাড়ির দিকে যেতে থাকে শত শত মানুষ। সদ্য কেটে ফেলা একটি ধানখেতে গাড়িটি থামানো হয়। গাড়িটি ঘিরে ধরে দল বেঁধে কান্নাকাটি করতে থাকে গ্রামের মানুষ। গাড়ি থেকে লাশ বের করে খাটিয়ায় রাখামাত্র মানুষ দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মোয়াজ্জেমের মুখ দেখে কান্নার রোল পড়ে যায়, কেউ কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে পড়ে যায়। এদের বেশির ভাগ সুন্নি। এমনকি নিহত মোয়াজ্জেমের সহোদর হাবিবর রহমানও সুন্নি।
লাশ আসার আগে সকালে হরিপুরের দক্ষিণপাড়ায় মোয়াজ্জেমের আধা পাকা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় আঙিনায় কয়েক শ লোক। মোয়াজ্জেমের শোকাহত স্ত্রী কমেলা বেগমের (৫৫) সঙ্গে আহাজারি করছিলেন আরও কয়েকজন নারী। যাঁদের বেশির ভাগই তাঁদের প্রতিবেশী, গ্রামের লোক।
মোয়াজ্জেমের ছেলে ইটভাটার শ্রমিক শাহাজুল ইসলাম বলেন, ‘বসতবাড়িসহ বিঘা খানেক জমিই সম্বল। বাবা টুকটাক সাংসারিক কাজ করতেন। মসজিদে আজান দিলেও কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না।’ শাহাজুল বলেন, তাঁর বাবা কয়েক বছর আগে শিয়া মতাদর্শ গ্রহণ করলেও তাঁর চাচারা সুন্নি।
হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ সুলতান বলেন, ‘এখানে একই পরিবারের শিয়া-সুন্নি দুই-ই রয়েছে। আমি সুন্নি, আমার ভাই হাবিল মিয়া শিয়া। তাই এখানে কে শিয়া কে সুন্নি তা বাছবিচার করাই নিরর্থক।’

No comments

Powered by Blogger.