পণের পণ্য থেকে অন্য ভুবনে

আফগানিস্তানের মেয়ে সোনিয়া আলীজাদেহ। এখন ইরান হয়ে এখন তাঁর বসবাস যুক্তরাষ্ট্রে। বয়স ১৯ বছর, কাজ করছেন র‍্যাপশিল্পী হিসেবে। শৈশবে তাঁর জীবনে ঘটে যায় একটা বাজে ঘটনা। ভাইয়ের বিয়ের খরচ জোগানোর জন্য শিশু সোনিয়াকে ওই বয়সে কনে হিসেবে বিক্রি করতে চেয়েছিল তার পরিবার। নিজেকে পণ্য হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে সোনিয়া এখন র‍্যাপশিল্পী। লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘উইমেন ইন ওয়ার্ল্ড’ সম্মেলনে নিজের এমন অভিজ্ঞতা আর অর্জনের কথা সবাইকে জানালেন সোনিয়া। তাঁর সে গল্পই তুলে ধরেছে বিবিসি অনলাইন ও ডেইলি মেইল। সেসব খারাপ দিনের কথা প্রসঙ্গে সোনিয়া বলতে থাকলেন, তাঁর বয়স যখন আট, তখন তাঁর পরিবার আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে ইরানে চলে যায়। ১০ বছর বয়সে তিনি অবাক করার মতো একটি বিষয় লক্ষ করেন—তাঁর প্রতি হঠাৎ করে বাবা-মায়ের অতি মনোযোগ। তাঁকে নতুন কাপড় কিনে দেওয়া হলো। একদিন মা তাঁকে সাজগোজ করে তৈরি হতে বললেন এবং জানালেন, কনে হিসেবে দেখানো হবে তাঁকে। যা-ই হোক, সে যাত্রায় বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়নি তাঁকে। তবে ১৬ বছর বয়সে তিনি আবার একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। সে সম্পর্কে সোনিয়া বলেন, ‘আমার বয়স তখন ১৬। আমি তেহরানে কাজ করি। আমার মা একদিন দেখা করার জন্য আমার কাছে এলেন। বললেন, আমাকে আফগানিস্তানে ফিরে যেতে হবে। অচেনা এক পুরুষকে বিয়ে করতে হবে। কারণ হিসেবে মা বললেন, বিয়ের জন্য আমার ভাইয়ের মোটা অঙ্কের (সাত হাজার ডলার) পণ দরকার। আর আমাকে বিয়ে দিয়ে আমার পরিবার পণ হিসেবে নয় হাজার ডলার পাবে। আমার ভাইয়ের বিয়ের খরচের পরও দুই হাজার ডলার বাড়তি পাবে আমার পরিবার। এ কথা শুনে আমার দম আটকে গেল, আমি বাকরুদ্ধ। মায়ের এই কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম, ভাইয়ের তুলনায় আমি কতটা মূল্যহীন।’ সোনিয়ার ভাষায়, ‘আমার মা যখন আমাকে বিক্রি করার কথা বললেন, শুনে আমার হৃদয়টা ভেঙে গেল।’ সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর উপলব্ধি, ‘অল্প বয়সে জোর করে যেসব মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়; তাদের শৈশব হারিয়ে যায়। তারা হয়ে পড়ে আশাহীন।’ কষ্ট পেলেও হাল ছাড়েননি সোনিয়া। তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে আফগানিস্তানে ফিরে যাননি। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তিনি গান লিখতে শুরু করেন। সেসব র‍্যাপ গান গেয়ে তা রেকর্ড করেন। তবে কাজের বৈধ অনুমতিপত্র না থাকায় তিনি বেশি দিন ইরানে থাকতে পারেননি। ইরানে থাকার সময় তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্নানাগার পরিষ্কারের কাজ করতেন। ২০১৪ সালে সোনিয়া ইউটিউবে ‘বিক্রির জন্য কনেরা’ শিরোনামে একটি ভিডিও আপলোড করেন। এখানে তিনি তুলে ধরেন, আফগানিস্তানে প্রতিবছর ১৫ শতাংশ মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়। বিয়ের নামে পণ্য হিসেবে বিক্রি হয় কন্যাশিশুরা। এই র‍্যাপ গান করতে করতে ভাগ্য খুলে যায় সোনিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রে সংগীত বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ পান তিনি। এখন পড়াশোনা করছেন, চালিয়ে যাচ্ছেন র‍্যাপ গানও। নারীদের বিশ্ব সম্মেলনে আফগানিস্তানে নারীর জীবন কেমন, সে বিষয়ে সোনিয়া বলেন, ‘আমার দেশে ভালো মেয়ে মানে যে চুপ থাকবে, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলবে না, পরিবারের কথা মেনে চলবে। ভালো মেয়ে মানে তাকে পুতুলের মতো থাকতে হবে, আর সবাই তাকে নিয়ে খেলবে।’ তাঁর জীবনটা আফগানিস্তানের অন্য মেয়েদের মতো না হওয়ার কারণ বেশ স্পষ্ট করে বললেন সোনিয়া। তাঁর ভাষায়, ‘সুন্দর একটা জীবনের স্বপ্ন আমার ছিল। তাই আমি হাল ছাড়িনি। আমি আমার স্বপ্নের কথা কখনো ভুলিনি

No comments

Powered by Blogger.