ইন্টারনেট ব্যবহার নয়, আসক্তিই সমস্যা’

ইন্টারনেটের অপব্যবহারের কারণে শিশু-কিশোরেরা নানা ধরনের ঝুঁকিতে থাকে। সমস্যা সমাধানে ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের আরও বেশি করে আলোচনা করা উচিত। এ ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার জন্যও যোগ্য লোকজন দরকার।‘নিরাপদ ইন্টারনেট: আগামী প্রজন্ম ও আমাদের দায়িত্ব’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে। গতকাল শনিবার সকালে ডেইলি স্টার ভবনে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। গ্রামীণফোন, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার যৌথভাবে এই আলোচনার আয়োজন করে। সঞ্চালনা করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য সালেহ উদ্দিন আহমেদ।আলোচনার শুরুতে গ্রামীণফোন পরিচালিত একটি গবেষণার তথ্য দিয়ে বলা হয়, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩০ শতাংশেরও বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার অথবা এরা ইন্টারনেটে উত্ত্যক্তকারীদের অশোভন বার্তা পেয়েছে। এদের বেশির ভাগই ছাত্রী।
গবেষণায় বলা হয়, ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে, ইন্টারনেটে কোনো সমস্যায় পড়লে তাদের সাহায্য বা দিকনির্দেশনা দেওয়ার কেউ নেই। কারণ বিদ্যালয়, শিক্ষক বা অভিভাবকেরা এ বিষয়ে যথেষ্ট সক্ষম নন। ফলে শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে তাদের বাবা-মা ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করার চেয়ে বেশির ভাগ সময়ই বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরেরা কীভাবে ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পর্নোগ্রাফিসহ নানা বাজে সাইটে ঝুঁকে পড়ছে, সেসব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, ইন্টারনেটে যেমন খারাপ দিক আছে, তেমনি ভালো দিকও আছে। কিন্তু অভিভাবকেরা বেশির ভাগ সময়েই এগুলো বুঝতে চান না।
আলোচনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ হয়, তাতে নারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। মাত্র ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান। তারানা হালিম বলেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন কাউন্সেলর থাকলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারত। কিন্তু সেটি নেই। এখন যদি মোবাইল অপারেটরগুলো স্বাস্থ্য, কৃষির মতো এমন একটা নম্বর রাখত, যেখানে ফোন করে এই সমস্যার সমাধান করা যেত। ফোন কোম্পানিগুলোকে তিনি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইন্টারনেটে কিছু লোক সাম্প্রদায়িকতা ও উসকানি ছড়াচ্ছে। এসব প্রতিরোধে সরকার কাজ করছে। দেশের বাইরে থেকে যেসব আপত্তিকর উপাদান আসে, সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজও চলছে।সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহার নয়, আসক্তিই সমস্যা। সেই আসক্তি দিন দিন বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা জরুরি। প্রতিটি স্কুলে বাচ্চাদের এসব বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার অন্তত একজন শিক্ষক থাকা দরকার।ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহার একটি স্বাধীনতা। এটি বন্ধ করার সুযোগ নেই। কাজেই এর ভালো ও মন্দ দিক সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে।প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, ‘ইন্টারনেট আর সাইবার অপরাধ দমনে আমাদের রাষ্ট্রকে যোগ্য ও দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতিতেও প্রয়োজনে এটি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
গ্রামীণফোনের প্রধান করপোরেট কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন বলেন, গ্রামীণফোন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের জীবন উন্নত করতে এবং একই সঙ্গে সেখানে নিরাপদে থাকতে সহায়তা করতে চায়।
সানিডেল স্কুলের উপাধ্যক্ষ ইয়াসমিন হাবিব বলেন, ফেসবুক, অনলাইন, ইন্টারনেট—এসব ব্যবহার করতে করতে বাচ্চাদের অনুভূতিই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক আসিফ সালেহ, ইউনিসেফের কর্মকর্তা জামিলা আক্তার ও বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারের কর্মকর্তা এজাজ আহমেদসহ অনেকেই বললেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ সমাজের যেসব সমস্যা আছে, সেগুলোই ইন্টারনেটে প্রতিফলিত হয়। কাজেই সমাজটা ঠিক করতে হবে। শিশুদের শুধু খেলনা আর যন্ত্রপাতি কিনে না দিয়ে তাদের সময় দিতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।সেভ দ্য চিলড্রেনের ব্যবস্থাপক লায়লা করিম বলেন, ‘আমরা আমাদের শিশুদের সময় দিচ্ছি না। তাদের কথা শুনছি না। কিন্তু সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক অভিভাবকত্ব দরকার।’সিএসআর সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহমীন এস জামান, গ্রামীণফোনের হেড অব করপোরেট রেসপনসিবিলিটি দেবাশীষ রায়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।

No comments

Powered by Blogger.