প্রথমবার বাজল সরস্বতী বীণা by : প্রণব ভৌমিক

জয়ন্তী কুমারেশ গতকাল যখন তাঁর সরস্বতী বীণা নিয়ে মঞ্চে উঠলেন, তখনো দর্শকসারি বেশ ফাঁকা। রাতের দ্বিতীয় পরিবেশনা বলে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তবে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সৌভাগ্যবান। শ্রোতামন জয় করে নিজ নামের সার্থকতা প্রমাণ করেন এ শিল্পী। বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৫’-এর দ্বিতীয় রাতের দ্বিতীয় পরিবেশনায় ছিল জয়ন্তীর বীণাবাদন। প্রথমে তিনি আদি তালে স্বামী ত্যাগরাজের একটি কম্পোজিশন, পরে দক্ষিণ ভারতীয় রাগ কাফি ও বেহাগ পরিবেশন করেন।  এমনিতে বীণাবাদক হিসেবে জয়ন্তীর বেশ সুনাম আছে। সময়ের শীর্ষস্থানীয় বীণাশিল্পী তিনি। নিজের গুরু ওস্তাদ জাকির হোসেন ও আর. কুমারেশের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়ার বিরল সম্মান তাঁর ঝুলিতে। তবে সংশয় ছিল, কেমন শোনাবে সরস্বতী বীণার সুর? প্রাচীন দক্ষিণ ভারতীয় এ বাদ্যযন্ত্রটি এর আগে ঢাকার শ্রোতারা তো শোনেনি! জয়ন্তীর বাদ্যযন্ত্র শুনে চোখ-কানের বিবাদ ঘুচেছে।
জয়ন্তীর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন মৃদঙ্গমে আর শংকরনারায়ণন, ঘটমে এস কৃষ্ণস্বামী। পরিবেশনার একপর্যায়ে পাল্টাপাল্টি মৃদঙ্গম ও ঘটমের তালে তাঁরা শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। দ্বিতীয় দিনের পরিবেশনা শুরু হয় যথারীতি সন্ধ্যা সাতটায়, বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কুণ্ডুর ধ্রুপদ দিয়ে। পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরের তত্ত্বাবধানে এখন শিখছেন তিনি। প্রায় ২৫ মিনিটের সংক্ষিপ্ত পরিবেশনায় তিনি রাগ ভূপালি পরিবেশন করেন। তৃতীয় পরিবেশনায় খেয়াল গাইতে মঞ্চে ওঠেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সুস্মিতা দেবনাথ। তিনি শিখছেন পণ্ডিত উলহাস কশলকরের কাছে। সুস্মিতার খেয়ালটি ছিল ২০ মিনিটের। রাগ বেহাগে রচিত খেয়ালটি সুস্মিতা খুব সুন্দর করে গাইলেন। এরপর মঞ্চে ওঠেন ধ্রুপদ পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর। তিনি রাগ ইমনের ধ্রুপদ গাইলেন। গম্ভীর ধ্রুপদ শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দিল শাস্ত্রীয় সংগীতের আদিরূপের সঙ্গে। এ প্রতিবেদন লেখার সময় মঞ্চে মাত্রই উঠেছিলেন পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকর। প্রথম দিনটিও ছিল বর্ণিল: পাঠকেরা এরই মধ্যে প্রথম আলোর পাতায় পড়েছেন উৎসবের প্রথম দিনের প্রথম ভাগের পরিবেশনার বিবরণ। এরপর রাহুল শর্মা সেদিন সন্তুরের সুরে মাতিয়ে দিয়ে প্রমাণ করলেন, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার যোগ্য উত্তরসূরি তিনি। মঞ্চে বসে একটি কথাও বললেন না, মনের আনন্দে একটানে বাজিয়ে গেলেন দক্ষিণ ভারতীয় রাগ বাচস্পতির আলাপ, জোর, ঝালা, ঝাপতাল ও তিনতালের অনবদ্য সব কম্পোজিশন।
এরপর রাগ মালকোষে কৌশিকী চক্রবর্তী ধরলেন গান ‘কোয়েলিয়া বোলে’। এ দিনে চেনা কৌশিকীকে যেন পাওয়া গেল না। সকালে হোটেলের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিবারই এখানে এসেছি। এখন এটা আর আসা নয়, ফিরে আসা। কিন্তু মুশকিল হলো, ঘন ঘন এলে দর্শকপ্রত্যাশা বেড়ে যায়।’ সেই চাপই কি প্রথম দিনের পরিবেশনার সময় তিনি অনুভব করছিলেন? কৌশিকী মঞ্চেই বলেন, ‘কিচ্ছু হচ্ছে না’। পাতিয়ালা ঘরানার গায়কি আসলে পুরুষালি। একজন নারীর পক্ষে সেটা হুবহু অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। কৌশিকী গায়কি ও নান্দনিকতার সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। মালকোশের পর একটি দাদরা, তারপর কৌশিকী গাইলেন রাগ মান্দের একটি বন্দিশ ‘সাভরা মারি’। একই সঙ্গে গাইলেন একটি রবীন্দ্রসংগীত ‘বঁধু, মিছে রাগ কোরো না’। কৌশিকীর পর মঞ্চে এলেন পণ্ডিত কুশল দাস। হেমন্ত রাতে রাগ হেমন্ত দিয়েই শুরু করলেন তিনি। সেতারের সুরে হেমন্তের বাতাস যেন বয়ে যাচ্ছিল আর্মি স্টেডিয়ামজুড়ে। একমনে বাজিয়ে গেলেন। শেষ করলেন রাগ পাহাড়ির ধুন দিয়ে। শেষ পরিবেশনার জন্য মঞ্চে ওঠেন বিদুষী বোম্বে জয়শ্রী। অস্কার মনোনয়নপ্রাপ্ত এ সংগীতজ্ঞের জন্য সমঝদার শ্রোতারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। পরপর শোনালেন অনেকগুলো রাগ-রাগ হংসধ্বনি, মায়া মল্লব গৌড়া, কলাবতী, হংসনন্দী। শ্যাম কল্যাণ রাগে মীরাবাঈয়ের একটি ভজন ও রাগ দেশ-এ তিল্লানা শুনিয়ে প্রথম রাতের সমাপ্তি টানেন তিনি। এ দিনটি ছিল সুরের কারুকাজে বর্ণিল। আয়োজনের তৃতীয় দিনে আজ সন্ধ্যা সাতটায় উৎসবের পর্দা উঠবে শাস্ত্রীয় মণিপুরি নৃত্য দিয়ে। পরিবেশনা করবেন ওয়ার্দা রিহাব ও তাঁর দল। ধ্রুপদ শোনাবেন ওস্তাদ ওয়াসিফউদ্দিন ডাগর। সরোদ শোনাবেন ইউসুফ খান, বেহালায় থাকবেন ড. এন রাজম। খেয়াল গাইবেন বিদুষী শ্রুতি সাদোলিকর। গতবার গুরু করাইকুড়ি মানির অসাধারণ মৃদঙ্গমবাদ্য শুনে এবারও নিশ্চয়ই শ্রোতারা তাঁর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
আজকের দিনের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বিদুষী শুভা মুদগালের খেয়াল শুনতে শ্রোতাদের অপেক্ষা করতে হবে অনেক রাত পর্যন্ত। অন্য সব পরিবেশনার পরই তিনি উঠবেন মঞ্চে।

No comments

Powered by Blogger.