পুলিশের রাইফেলে গুলি ছিল না by গোলাম মর্তুজা ও অরূপ রায়

আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় কর্তব্যরত পাঁচ পুলিশ সদস্যের কারও রাইফেলেই গুলি ছিল না। তাই হামলার শিকার হওয়ার পরে তাঁরা কোনো পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। তিনজন পুলিশ সদস্য তো শালবনের দিকে দৌড়ে পালিয়েই গেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার আশুলিয়া ও ঢাকা জেলা পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
গত বুধবার সকালে রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় পুলিশের একটি তল্লাশিচৌকিতে হামলা চালায় দুই ব্যক্তি। তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কনস্টেবল মুকুল হোসেন নিহত এবং কনস্টেবল নূরে আলম সিদ্দিকী গুরুতর আহত হন। নূরে আলমকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এদিকে আগের হামলাগুলোর মতো বুধবারের পুলিশের ওপর হামলার দায়ও আইএস স্বীকার করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে।
ওই হামলা ও হত্যার ঘটনায় আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আজাহারুল ইসলাম বাদী হয়ে বুধবার রাতে একটি মামলা করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা দুজনসহ আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত এ ঘটনায় জড়িত কাউকে ধরতে পারেনি পুলিশ। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপক চন্দ্র সাহাকে। এর বাইরেও পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি সফিকুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে সাহায্য করতে একটি বিশেষ দল গঠন করেছে পুলিশ। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহসিনুল কাদির বলেন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও গাজীপুরের সাত কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে। তাঁরা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে সহায়তা করবেন। ওই দলের দায়িত্বে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আবুল খায়ের।
ঢাকা জেলা ও আশুলিয়া থানার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেখানে কর্তব্যরত পাঁচ পুলিশ সদস্যের কাছে চায়নিজ রাইফেল থাকলেও তাঁরা সেগুলোর ব্যবহার করেননি। পরে পালিয়ে যাওয়া তিন সদস্য কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তাঁদের কারও রাইফেলেই গুলি ছিল না। কর্মকর্তারা জানান, রাইফেল ও গুলি পুলিশ সদস্যদের কাছে আলাদাভাবে ছিল। ওসব রাইফেলে গুলি ভরা খুব ঝক্কির নয়, তবে কিছু সময় লাগে। গুলি ভরা না থাকায় তাঁরা গুলি চালাতে পারেননি। তবে প্রতিরোধ না করে তিনজন কেন পালিয়ে গেলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে আশুলিয়া থানার ওসি মোহসিনুল কাদির বলেন, অস্ত্র থাকলেও তাঁদের অস্ত্রে¿গুলি ভরা ছিল না। এটা নিশ্চিত। তবে কী জন্য তাঁরা পালিয়ে গেলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বিবিসিকে বলেন, ওই তল্লাশিচৌকিতে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বয়সে নবীন ছিলেন।
গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাড়ইপাড়ার তল্লাশিচৌকিতে কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি। সেখানকার পাঁচটি খাবার হোটেল এবং একটি দোকান বন্ধ রয়েছে। লোকজনের উপস্থিতি ছিল কম। ঘটনাস্থলের উল্টো দিকে নন্দন পার্কের সামনে বিআরটিসির বাস ডিপোতে তিনটি বাস আর কয়েকজন পরিবহনশ্রমিক ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি।
গতকালও ঘটনাস্থলে পাওয়া যায় বাসচালক কনক দাসকে। তিনি বলেন, প্রকাশ্যে সশস্ত্র পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার পর থেকে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। বুধবার হামলার সময় তিনি ঘটনাস্থলের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হামলার পরে দুই হামলাকারীকে তিনি ছাই রঙের একটি মোটরসাইকেলে করে চন্দ্রার দিকে চলে যেতে দেখেন। ঘটনা সম্পর্কে জানতে পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর আবার ছেড়ে দিয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
গতকালের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কনকের বরাত দিয়ে ঘটনার বিবরণ ছাপার পর থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তাঁর মুঠোফোনে কল করে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে চাচ্ছে। এসব নিয়ে তিনি আতঙ্কে রয়েছেন। একই এলাকার মিলন রহমান বলেন, ‘যেখানে পুলিশই নিরাপদ নয়, সেখানে আমাদের নিরাপত্তা দেবে কে?’
তবে এই হত্যা-হামলাও পুলিশের মধ্যে সতর্কতা আনতে পারেনি। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের সিঅ্যান্ডবি এলাকায় তল্লাশিচৌকিতে একজন সশস্ত্র এএসআইসহ চার কনস্টেবলকে গা ছাড়াভাবে বসে থাকতে দেখা যায়। ওই চৌকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার এসআই কামরুজ্জামান তখন চৌকিতে ছিলেন না। এএসআই মুন্নু শেখ, কনস্টেবল জয়ন্ত মণ্ডল, গোপাল সাহা ও উজ্জ্বল খান সিঅ্যান্ডবির সাখাওয়াত শেখের দোকানে বসে গল্প করছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপে যোগ দিলে এএসআই মন্নু শেখ বলেন, ‘আমরাও আতঙ্কের মধ্যে আছি। সতর্কও আছি। তবে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।’ জয়ন্ত মণ্ডল বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করছি ভাই।’
মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তল্লাশিচৌকিতে না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কিছু সময় আগে খাওয়ার জন্য তিনি থানায় যান।
সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নূরে আলমের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। ঢাকা রেঞ্জের পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান গতকাল সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে তাঁর চিকিৎসার খোঁজখবর নেন।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, সাময়িকভাবে বাড়ইপাড়ার তল্লাশিচৌকি বন্ধ রাখা হলেও দুপুরের পর তা চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশকে আগের চেয়ে বেশি সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়েছে। দুষ্কৃতকারীরা আর যাতে হামলার সুযোগ না পায়, সে বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ হতাহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। গতকাল রাজধানীর গাবতলী-আশুলিয়া সড়কের একটি চৌকিতে পুলিশ সদস্যরা। (ইনসেটে) রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে পুলিশি তল্লাশি l ছবি: প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.