‘মানুষ কেমনে করে এই কাজ?’ by মানসুরা হোসাইন

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে
চিকিৎ​সাধীন গৃহবধূ শিউলি খাতুন। ছবি: জাহিদুল করিম
গৃহবধূ শিউলি খাতুনের (৩৬) দু চোখ সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা। স্বামী জুয়েল হাসান চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁর দু চোখ তুলে ফেলেছেন। প্রতিবেশীরা তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। আজ শুক্রবার সকালে হাসপাতালে চোখের ওই সাদা ব্যান্ডেজ খুলতেই আঁতকে ওঠেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের একজন বলে ওঠেন, ‘মানুষ কেমনে করে এই কাজ?’
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে টঙ্গীর জামাইবাজার এলাকার ভাড়া বাসায় স্বামী জুয়েল চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চোখ তুলে তাঁর স্ত্রীকে ভেতরে রেখেই বাসা তালাবদ্ধ করে চলে যান। চিৎকার শুনে পরে প্রতিবেশীরা পুলিশের সহায়তায় ঘরের তালা ভেঙে শিউলিকে উদ্ধার করেন। প্রথমে তাঁকে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখান থেকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। পথে দীর্ঘ যানজটের কারণে উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। পরে রাত পৌনে একটার দিকে তাঁকে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়।
গৃহবধূ শিউলি আজ প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছর আগে তিনি জুয়েলকে বিয়ে করেন। এটি তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়ের পর থেকেই দেখছেন স্বামী নেশা করে। আগের স্বামীর কাছ থেকে যে সম্পত্তি পাবেন, তা এনে দেওয়ার জন্য প্রায়ই তাঁকে মারধর করতেন জুয়েল। আর নেশার পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রায়ই সন্দেহ করতেন জুয়েল।
শিউলি বলেন, ‘ও ইয়াবা না কি জানি একটা খায়। ওই দিন নেশার পরিমাণ বেশি হইছিল। স্বামী সারাক্ষণই ঘর, বাইর করে। তারপরও আমারে সন্দেহ করে। বলে ঘরে কে আসছিল? বলতে বলতেই আমার মুখে স্কচটেপ মারে। দুই হাত পেছন দিকে বাইন্ধ্যা ফালায়। দুই পা বান্ধে। এক সময় খালি বুঝি আমার এক চোখ নাই। তারপর বেহুঁশ হইয়া যাই। এক সময় একটু একটু জ্ঞান ফিরলে চারপাশে খালি অন্ধকার দেখি। হাতের বান্ধা একটু আলগা মনে হয়। মুখ থেইক্যা স্কচটেপ টাইন্যা একটু খুইল্যা চিৎকার দেই। আর কিছু মনে নাই।’
চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহকারী রেজিস্ট্রার আতিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিউলির দুই চোখের ভেতরে আর কিছু নেই। এখন শুধু চোখের অবয়ব আছে। অবস্থা খুব ভয়াবহ। চোখের নার্ভের সঙ্গে মস্তিষ্কের নিবিড় সম্পর্ক আছে। হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ মিলে এই রোগীর ব্যবস্থা নিতে হবে। আজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগগুলো বন্ধ। আমি অন্য বিভাগের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কাল শনিবার রোগীর চোখে অস্ত্রোপচার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
শিউলির ভাই রনি ঢাকায় গাড়ি চালান। তিনি বলেন, এর আগে শিউলির আরেকবার বিয়ে হয়েছিল। ওই ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। মেয়েটা এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। বড় ছেলেও পড়াশোনা করছে। তারা তাদের দাদার বাড়িতে থাকে। শিউলির আগের স্বামী ২০০৯ সালে খুন হন। এর এক বছরের মাথায় শিউলি তাঁর স্বামীর চাচাতো ভাই জুয়েলকে বিয়ে করেন। এ বিয়েতে শিউলির বাবার পরিবার ও ছেলে-মেয়েরা রাজি ছিল না। তাই সবার সঙ্গে তাঁর একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
তবে শিউলির দ্বিতীয় বিয়ে হলেও জুয়েলের এটি প্রথম বিয়ে। জুয়েল টঙ্গীতে ইট-বালুর ব্যবসা করেন। ঘটনার পর পরিবারের পক্ষÿথেকে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। জুয়েল ঘটনার পর থেকেই পলাতক।
একই বাসার আরেক ভাড়াটে ও পুলিশের সহায়তায় শিউলিকে উদ্ধারকারী আলী আহমেদ হাসপাতালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানবিক কারণে আমি ও অন্য ভাড়াটেরা তাঁকে উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে দৌঁড়াচ্ছি।’
আলী আহমেদ বলেন, শিউলি বাসায় আসার পর থেকেই তাঁদের স্বামী-স্ত্রী ঝগড়াঝাঁটির কারণে বাড়িওয়ালা ও অন্য ভাড়াটেরা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এ কারণে ঘটনার দিন (বৃহস্পতিবার) বিকেল পাঁচটার মধ্যে জুয়েলকে বাসা ছেড়ে দিতে বলা হয়। জুয়েল বিকেল চারটার দিকে ঘটনা ঘটিয়ে বাইরে থেকে দরজা তালা মেরে বেরিয়ে যান। এরপর থেকেই জুয়েল পলাতক।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নেশা নিজেই একটি মানসিক রোগ। নেশার ফলে রোগীর মধ্যে অন্যান্য মানসিক রোগ তৈরি হয়। ইয়াবা সেবনকারীদের মধ্যে বিভিন্ন সন্দেহবাতিকতা দেখা দেয়। কেউ তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে বলেও অনেকে মনে করতে থাকে। তবে ইয়াবা সেবনকারীদের মধ্যে স্ত্রীর চরিত্র বা সতীত্ব নিয়ে সন্দেহের মাত্রা বেড়ে যায়। একে বলা হয় ‘ওথেলো সিনড্রোম’। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর চরিত্র সম্পর্কিত অতীত ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক থাকে না। তাই মাদকাসক্তদের চিকিৎসাটি গুরুত্বপূর্ণ। রোগীকে যথাযথ চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হলে সমাজ থেকে এ ধরনের ঘটনা কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’

No comments

Powered by Blogger.