চবিতে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ২৫ বছরে নিহত ২২, ১২০০ তদন্ত কমিটি by মহিউদ্দীন জুয়েল

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুইপক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় গত ২৫ বছরে ১২০০ তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু একটি ঘটনারও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তবে ছাত্রী হয়রানি, সাধারণ ছাত্রকে মারধরের ঘটনায় বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে বিছিন্নভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে প্রশাসনকে। একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনায় বারবারই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ক্যাম্পাস। বাড়ছে সেশনজট। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, শাটল ট্রেনের বগি দখল, হল দখল, শোডাউন, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসনের লোকজন।
সর্বশেষ দুইপক্ষের সংঘর্ষে বছরখানেক আগে গুলিতে মারা গেছেন এক ছাত্রলীগ কর্মী। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রসংগঠনগুলোর কোন্দলে ও প্রকাশ্যে সংঘর্ষে ২২ জন ছাত্র নিহত হয়েছেন।
সব ঘটনায় তদন্ত কমিটি হলেও কোন ঘটনারই সুরাহা হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটিগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সদস্যরা কোন মন্তব্য না করে প্রশাসনকে দায়ী করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, সংঘর্ষের ঘটনায় তদন্ত কমিটির সদস্যরা একটি কারণে প্রতিবেদন জমা দিতে আগ্রহী হন না। সেটি হলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আশঙ্কা। যদি কোন ছাত্রলীগ নেতার বিপক্ষে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তবে দলীয় কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুনরায় অস্থিতিশীলতা তৈরি করে।
তারা শাটল ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। তালা লাগিয়ে দেয় ক্লাস রুমে। কেবল তাই নয়, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে শিক্ষক বাসে। ২০০৮ ও ২০১০ সালে তৎকালীন উপাচার্যদের আমলে শাহজালাল হলে মারামারির ঘটনায় ছাত্রলীগের কতিপয় কর্মীর বিরুদ্ধে এমন শাস্তি নেয়ার সিদ্ধান্ত হলে তারা ক্যাম্পাস অচলের হুমকি দেয়।
গত ২রা অক্টোবর ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ক্যাম্পাস। এ সময় ক্যাম্পাসে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়।
শোডাউন দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। এতে পুলিশসহ উভয়পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ১০০ দা, ছুরি, কিরিচসহ দেশীয় অস্ত্র। পাওয়া গেছে অত্যাধুনিক পাইপগান।
চলতি বছরের গত ৩০শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন চত্বর এলাকায় ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত বাংলার মুখ ও সিক্সটি নাইন নামের শাটল ট্রেনভিত্তিক দুটি সংগঠনের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এর কিছুদিন আগে সোহরাওয়ার্দী হলের সিট দখলকে কেন্দ্র করে বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সমর্থকদের মধ্যে একে অপরকে ছুরিকাঘাত করার ঘটনা ঘটে। ওই সময় জমির উদ্দিন, ইমাদ আহমেদ সাহেল, সাঈদ, রিমন, বিপুল ও পুলিশের উপ-পরিদর্শক ইউনুসকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
তারও কয়েক মাস আগে ২৬শে নভেম্বর ভিএক্স গ্রুপ ও সিক্সটি নাইন গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশসহ আহত হন ১০ জন।
তদন্ত কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুটি সূত্র জানায়, কেবল গত ৭ বছরে চবিতে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ৫০টির বেশি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের ২রা মে ছাত্রলীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় গঠন করা হয় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। এর সদস্য করা হয় আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুককে।
২০১২ সালের ২রা মার্চ পর্যন্ত এক মাসের ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ ছাত্রলীগের মারামারির কারণে। এ ঘটনায় জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. নুরুল আনোয়ারকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে ১৪ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
২০১৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষে নিহত হয় এক দলীয় কর্মী। এ ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ও মৃত্তিকাবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক খান তৌহিদ ওসমানকে আহ্বায়ক করা হয়। এই বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বর্তমান সময়ের সংঘর্ষের ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা এমন বিষয়ে জানতে ফোন করা হয় উপাচার্য প্রফেসর ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীকে। তিনি বলেন, আমি এর আগে উপ-উপাচার্য ছিলাম। এখন উপাচার্যের পদে আছি। ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার কোন ষড়যন্ত্র আমি বরদাশত করবো না।
হাটহাজারী থানার ওসি ঈসমাইল মানবজমিনকে বলেন, চবিতে ছাত্রলীগের যেসব ঘটনা ঘটছে তার প্রতিটি ঘটনা থেকে প্রচুর অস্ত্র, গুলি, পিস্তল, রামদা পাওয়া যাচ্ছে। কিছু ছাত্র ক্যাম্পাসে রাজনীতির নামে আসলে অস্থিতিশীল করা চেষ্টা করে। তাদের কারণে সবাইকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
চবি ছাত্রলীগের সভাপতি আলগীর টিপু মানবজমিনকে বলেন, আমি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করি। অতীতে ছাত্রলীগ যেভাবে পরিচালিত হয়ে এসেছে আমরা চাচ্ছি তার পরিবর্তন। দলীয় কর্মকাণ্ডের নামে কোন অপরাজনীতি আমরা হতে দেবো না।
অন্যদিকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজন বলেন, আমার দলে যারা রাজনীতি করছেন তাদের সবাই মেধাবী শিক্ষার্থী। কিন্তু এখন দলের ভেতর কিছু লোকজন ঢুকে পড়েছে, যারা ছাত্রলীগের নামে সন্ত্রাস ও আধিপত্য কায়েম করতে চায়। তাদের ব্যাপারে সবাই সতর্ক আছি।

No comments

Powered by Blogger.