ভারতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ বিতর্ক by মিজানুর রহমান খান

তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি—ভারতের সুপ্রিম কোর্টের উদ্দেশ্যে এ মুহূর্তে এর চেয়ে মোক্ষম কিছু বলার নেই। কারণ, কংগ্রেস ও বিজেপির এক অসাধারণ ঐক্যে বিচারপতি নিয়োগে যে কমিশন তৈরি করেছিল, সুপ্রিম কোর্ট ১৬ অক্টোবর তাকে অবৈধ বলে বাতিল করে দিয়েছেন।
গরু বিতর্ক ও বরেণ্য লেখকদের পুরস্কার ফেরতদানের ঘটনায় জেরবার বিজেপি রায় শুনে হতভম্ব। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ‘ব্যক্তিগতভাবে’ ব্লগে লিখেছেন, এটা টিরানি অব আনইলেকটেড বা ‘অনির্বাচিত ব্যক্তিদের স্বৈরশাসন’। তবে জেটলির মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস বলছে, ‘এই মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক। আদালত অবমাননার শামিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনেক সময় নির্বাচিত ব্যক্তিদের স্বৈরশাসকে পরিণত করে।’ তবে এতে সন্দেহ সামান্য যে নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত যেকোনো স্বৈরশাসন ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি। কেবল বিচারকের দ্বারা বিচারক নিয়োগের নিরঙ্কুশ একটি ব্যবস্থা বিশ্বে বিরল বলে আমাকে নিশ্চিত করেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক কেট মেলিসন। মিস কেটের কথায়, ‘আমি এটা সমর্থন করতে পারি যে ভারতের বিচার বিভাগ হয়তো বিচারক নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা করতে পারে। কিন্তু বিচারক নিয়োগে কেবল বিচারকদের থাকা প্রমাণ করে যে নিয়োগ–প্রক্রিয়ায় কোনো গণতান্ত্রিক জবাবদিহি নেই। এর ফলে বিচার বিভাগের পক্ষে তার সদস্য (বিচারক) নির্বাচনে যথোপযুক্তভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেকটাই ম্লান হতে পারে। কারণ, এতে নিজেদেরই অনুকরণ করার প্রবণতা বাড়বে।’ এই মতের সঙ্গে একমত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
‘প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচারপতি নিয়োগ দেবেন’ এই ব্রিটিশ উদ্ভাবন নিয়ে বহুকাল চলতে চলতে উপমহাদেশজুড়ে আজ ক্লান্তি চোখে পড়ে। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা হলো কমিশন করা। বিচারপতি নিয়োগে পাকিস্তান কমিশন ও উন্মুক্ত শুনানি দুটোই করেছে। বাংলাদেশ ২০০৮ সালে কমিশন করল, আদালতে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে তা উতরেও গেল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাকে বাঁচাল না।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট শুধু সংসদের তৈরি করে দেওয়া কমিশন বাতিল করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা একই সঙ্গে সংসদ দ্বারা বিলুপ্ত হওয়া কলিজিয়াম, যেটি প্রধান বিচারপতি ও অপর পাঁচ জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নিয়ে গঠিত, সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন এবং এই কলিজিয়াম যে ত্রুটিপূর্ণ সে বিষয়ে আইনপ্রণেতাদের উদ্বেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আগামী ৩ নভেম্বর শুনানির তারিখ ধার্য করেছেন। প্রধান বিচারপতি এইচ এল দাত্তু বলেছেন, সবাই পরিপক্ব, তাই সরকার জানবে রায় কী করে মেনে নিতে হয়। কিন্তু প্রশ্নটি মোটেই এতটা আটপৌরে নয়। ভারতকে অবশ্যই একটি উন্মুক্ত, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও স্বচ্ছ ব্যবস্থায় যেতে হবে।
নিরপেক্ষভাবে বিচারপতি নিয়োগ সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ, নিরপেক্ষভাবে বিচারক বাছাই ও নিয়োগ–প্রক্রিয়ার গতিশীল অস্তিত্ব ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্থপূর্ণ হতে পারে না, প্রকৃত স্বাধীনতা প্রবেশ করতেই পারে না।
বাংলাদেশের মতোই ভারতের সংবিধানে লেখা ছিল রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচারক নিয়োগ দেবেন। এই পরামর্শ রাষ্ট্রপতি মানে সরকার করতেন, কিন্তু মানতে বাধ্য ছিলেন না। ১৯৮১ সালে এস কে গুপ্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সে কথা মানলেন। তবে বললেন, পরামর্শটা কার্যকরী হতে হবে। শেষ কথা রাষ্ট্রপতি, মানে, মন্ত্রিসভা বলবেন।
১২ বছর পরে ১৯৯৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট আগের রায় উল্টে দেন। এবার বলেন, না, শেষ কথা বলবেন সুপ্রিম কোর্ট। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মৌলিক কাঠামো। সরকারের কথা শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হলে ওই মৌলিক কাঠামো আঘাতপ্রাপ্ত হয়। কারণ, বিচারক হতে কে যোগ্যতম তা সুপ্রিম কোর্টই ভালো বলতে পারবেন। তবে তাঁরা নিজেরাও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। রাষ্ট্রপতি নিজেই যখন রেফারেন্স পাঠিয়ে মতামত চাইলেন, তখন তাঁরা আর ব্যক্তি প্রধান বিচারপতির ওপরে থাকলেন না। তাঁরা একটি কলিজিয়াম করলেন। বললেন, প্রধান বিচারপতি মানে এক মাথার ব্যক্তি নন। আর তাই কলিজিয়ামে আরও পাঁচ বিচারপতি অন্তর্ভুক্ত হলেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই কলিজিয়ামের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তির নিক্ষেপ চলছিল। কলিজিয়ামের মূল লেখক প্রধান বিচারপতি ভার্মা নিজেই অবসরে গিয়ে বলেছেন, আমি মত পাল্টালাম। এতে সংশোধনী আনাই সমীচীন।
এটা অত্যন্ত বিরল ঘটনা যে মূল রায় প্রকাশের পরেও আকর্ষণ ফুরায়নি, কারণ যা নিয়ে বিরোধ, আদালতই মানছেন সে বিষয়ের ফয়সালা হয়নি। একই মামলা কিন্তু যমজ রায়, কোনটিকে মাইলফলক বলব, তা দ্বিতীয় রায় না জেনে বলা যাবে না। বাংলাদেশি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী মনে করেন, ‘রায় দানের পরে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের ওই বেঞ্চ ফাংটাস অফিসিও (আর কোনো কার্যকারিতা নেই) হয়েছেন। তাঁর পক্ষে এখন আর শুনানি করা সমীচীন নয়।’
আইনি তর্কে যাব না। এই যমজ রায় এড়ানোই উচিত ছিল। আমরা এও দেখলাম, কমিশন বাতিলে পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চ একমত হতে পারেননি। তাঁরা ৪: ১ ভোটে বিভক্ত হয়েছেন। অথচ এই কমিশন গঠনে কংগ্রেস-বিজেপি বিভক্ত হয়নি। আর যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ন্যায়বিচার করা যায়, তাহলে বিচারক নিয়োগেও করা যাবে। রাজনীতিকেরা শ্রেণি হিসেবে অগ্রহণযোগ্য, বিচারকেরা শ্রেণি হিসেবে বেশি গ্রহণযোগ্য—যুক্তিটা ভঙ্গুর। রাজনীতিক বাদ দিয়েও বিভিন্ন পেশার লোক সমন্বয়ে কমিশন করা চলে।
ভারতকে এমন ব্যবস্থায় যেতে হবে, যাতে কোনো বিশেষ শ্রেণির শ্রেষ্ঠত্ব থাকা বা না থাকা জ্বলন্ত না হয়ে ওঠে। মিডিয়া সুপ্রিম কোর্টের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির সময়টা বিজেপির জন্য অনুকূল নয়। উপমহাদেশীয় রাজনীতি আজও হাওয়া বুঝে চলার প্রবণতা দেখিয়ে থাকে। ‘বর্তমান সরকারের ওপর আদালতের আস্থা নেই’ বলার মতো জনপ্রিয় অবস্থান নিতে কংগ্রেস কোনো বিলম্ব করেনি। কংগ্রেস কেন এর পক্ষে ভোট দিয়েছিল, সেটা তার উচিত ছিল আগে ব্যাখ্যা করা।
নভেম্বরের সম্ভাব্য রায়ে বিচারক নিয়োগ বিতর্কের চির অবসান ঘটাবে বলে মনে হয় না। রায়ের আলোকে সংবিধানে নতুন সংশোধনী আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় ১৭ অক্টোবরে হায়দরাবাদের নালসার আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফাইজান মুস্তাফা ‘সাংবিধানিকতাবাদের বিজয়’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেদিনই তাঁকে লিখলাম ও জানতে চাইলাম, ভারতের সংবিধান কঠিনভাবে ক্ষমতার পৃথক্করণের ভিত্তিতে গড়া। রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য এর সীমা কত দূর অতিক্রম করতে দেওয়া সমীচীন?’
কলিজিয়ামের পাঁচ সদস্যই বিচারক ছিলেন। আর ছয় সদস্যের কমিশনে বিচারক ছিলেন প্রধান বিচারপতিসহ তিনজন। বাইরের লোক বলতে আইনমন্ত্রী, আরও দুজন আইনবিদ। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও বিরোধী দলের নেতা বসে ওই দুজন ঠিক করবেন। মামলা বিচারাধীন বলে মোদির ডাকা বৈঠকে প্রধান বিচারপতি হাজির হননি।
ফাইজানের মতে, এটাই উদ্বেগের যে ‘যেকোনো দুজন কারও মনোনয়ন আটকে দিতে পারে।’ তিনি যেন ধরে নিয়েছেন শ্রেণি হিসেবে তিন বিচারক সব সময় ঐকমত্যে থাকবেন। আর বাগড়া দেবেন আইনমন্ত্রী ও দুই আইনবিদের মধ্যে অন্তত একজন। অথচ সরকারের প্রস্তাবও যেকোনো দুই বিচারক আটকে দিতে পারেন। এই ক্ষমতা যখন দুই দিকে থাকবে, তখন গঠনমূলক আপস হওয়ার কথা। এও সত্য, বাগড়া দেওয়াটা সরকারই বেশি দেখাতে পারে। তা ছাড়া, দুই সংখ্যালঘুর স্বৈরশাসন মানা যায় না।
প্রধান বিচারপতির মতের প্রাধান্য মানেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ, এটি একটি উপমহাদেশীয় ধারণা, যা দুর্বল হয়ে পড়ছে। ভারতের বাইরে একে আমরা ‘রূপকথা’ হিসেবে, গোত্রগত স্বার্থে ব্যবহৃত হতে দেখেছি।
২০০৮ সালে আট সদস্যের যে কমিশন বাংলাদেশে চালু (বর্তমানে বিলুপ্ত) হয়েছিল, তাতে বিচারকদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৮: ৫) ছিল।
অধ্যাপক ফাইজান স্বীকার করেন ‘কলিজিয়াম সংবিধানের মূল পাঠ থেকে যথেষ্ট বিচ্যুত হওয়া একটি ব্যবস্থা। কিন্তু ক্ষমতার পৃথক্করণ সত্ত্বেও সংবিধান ব্যাখ্যা করার অধিকার সুপ্রিম কোর্টের আছে।’ এর আগে এই অবাক করা ‘সংবিধান-বিচ্যুতির’ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি আলতামাশ কবীর ঢাকায় আমাকে বলেছিলেন, ‘কলিজিয়াম সংবিধানের বাইরে, তা আমি মানি না।’ আসলে ১৮ বছর ধরে বিচারকসর্বস্ব কলিজিয়াম যে কার্যকর থেকেছে, তার কৃতিত্ব নির্বাহী বিভাগের, তারা প্রশ্ন তোলেনি।
‘বর্তমান সময়ে এটাই সমর্থন করা দরকার যে কমিটেড বিচারক দিয়ে সরকার যাতে “কোর্ট প্যাকিং” (রুজভেল্ট দলীয় লোক এনে সুপ্রিম কোর্ট বোঝাই করেছিলেন, সেই থেকে কোর্ট প্যাকিং কথাটির প্রচলন) না করতে পারে’—ফাইজানের এই অবস্থানকে যথার্থ বলেই মনে হয়। গোপাল সুব্রামনিয়ামকে বিচারক হতে অন্যায্যভাবে আটকে দিয়ে মোদি সরকার তার বিতর্কিত যাত্রা শুরু করেছিল। এই কলামে তার প্রতিবাদ করেছিলাম।
বিচারক বাছাইয়ের প্রাথমিক প্রক্রিয়া সুপ্রিম কোর্টের থেকে সরকারের কাছে নেওয়ার বিধান অবশ্যই সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করেছে। এটা থাকতে পারে না। ভারতে প্রকাশ্য গণশুনানি চালুর ফল ‘নোংরা’ হবে বলে ফাইজান মনে করেন। কিন্তু এই নোংরা হওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও আমি এর প্রচলন সমর্থন করি। ফাইজান ইঙ্গিত দেন যে রুদ্ধদ্বার কক্ষে সুপ্রিম কোর্টের ৩১ বিচারকের সামনেও শুনানি হতে পারে না। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদেরও কলিজিয়ামে নেওয়া যাবে না। কারণ, তাতে রাজনীতি হবে। প্রশ্নের উত্তরে ফাইজান কেবল আইনের অধ্যাপকদের যুক্ত করতে রাজি হয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. জন ব্রেইথওয়েট এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কালিশ্বরণ রাজেরও অভিমত নিয়েছি, তাঁরাও এতে একমত। রাজের মতে, বিচার বিভাগ যেমন স্বাধীন, তেমনি বিচারক নিয়োগব্যবস্থাও স্বাধীন হতে হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এই ত্রুটিপূর্ণ রায়ের অসামান্য প্রভাব পড়বে উপমহাদেশে। লাহোরে যোগাযোগ করা হলে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ বেলাল ও আলী আসগর চিমা ওই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে স্বাগত জানান। ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল অন্য ১৪ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে হাজির করেন এটা দেখাতে যে এখানে ‘বিচার বিভাগের সঙ্গে কোনো দালিলিক প্রমাণসাপেক্ষ কোনো পরামর্শ ছাড়াই নির্বাহী বিভাগ বিচারক নিয়োগ দিয়ে থাকে।’
কেমব্রিজের ওই অধ্যাপক কেট মেলিসন, যিনি ২০০৬ সালে বিশ্বের বিচারক নিয়োগের ওপরে একটি বই সম্পাদনা করেছেন, ভারতের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ২২ অক্টোবর আমাকে লেখা তাঁর একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করি: ‘বিচারক নিয়োগ–প্রক্রিয়া শ্রেয়তর করতে হলে সেখানে বিভিন্ন গ্রুপের সম্মিলনী উত্তম। রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গের হাতেই এর ভার নিরঙ্কুশভাবে থাকা উচিত নয়।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.