দীপন হত্যার দায়ে মাদরাসা শিক্ষক আটক

প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ডের ছয় দিন পরে ফেনীর ফুলগাজী থেকে মুফতি জাহিদ হাসান মারুফ নামের এক মাদরাসা শিক্ষককে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
আজ শুক্রবার ভোররাতে উত্তর তারাকুচা গ্রাম থেকে তাকে আটক করে ঢাকায় আনা হয়।
মুফতি জাহিদ বর্তমানে মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে আছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তবে ফুলগাজী থানা পুলিশ আটকের বিষটি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীপন হত্যার রহস্য উম্মোচনে সন্দেহভাজন আটজনের একটি গ্রুপকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে অভিযানে নেমেছে গোয়েন্দারা। এছাড়া শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে চিহ্নিত করতে পারেনি গোয়েন্দারা। অপরাধীদের গ্রেফতার এবং নেপথ্যের নায়কদের সন্ধানে একাধিক টিম অভিযানে নেমেছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এদিকে আহমেদুর রশীদ টুটুল আজ সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জানালেন, মুক্তবুদ্ধির লড়াইয়ে পিছু হটবেন না তিনি। এর আগে দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হওয়ার পর গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, বই প্রকাশ বন্ধ হবে না। মুক্তবুদ্ধির চর্চা বন্ধ হবে না।
মারুফের বাবা মুফতি হাবিব উল্লাহর বরাত দিয়ে ফেনী অফিস ও ছাগলনাইয়া সংবাদদাতা জানান, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা ও দীপন হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য রয়েছে মর্মে বৃহস্পতিবার ভোররাত ৩টার দিকে একদল পুলিশ অভিযান চালায়। তারা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তার বাড়ি ও মাদরাসায় অভিযান চালিয়ে মুফতি মারুফকে আটক করে নিয়ে যায়। মুফতি হাবিব উল্লার দাবি, তার ছেলে এসব কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নয়।
আমজাদ হাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইব্রাহিম জানান, বিষয়টি তিনি মারুফের বাবার কাছ থেকে শুনেছেন। একই কথা জানান ফুলগাজি থানার পরিদর্শক মাইন উদ্দিনের।
তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযানের আগে স্থানীয় থানাকে জানানো হয়। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো তথ্য তাদেরকে জানানো হয়নি। তবে তিনি গ্রেফতারের বিষয়টি শুনেছেন।
মারুফ এধরনের কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নয় বলে দাবি করেন মুফতি হাবিব উল্লাহ।
তিনি বলেন, নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকেই ছেলে মারুফ প্রাথমিক শিক্ষার পর ছাগলনাইয়া মাদরাসা থেকে দাওরা (টাইটেল) পাশ করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসা থেকে ইসলামি আইন শাস্ত্রে (মুফতি) দুই বছরের পড়ালেখা করেন। সেখান থেকে আবার গ্রামের বাড়িতে এসে ওই মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তার মাদরাসাটি প্রাথমিক পর্যায়ের। আটটি ক্লাস রয়েছে মাদরাসাটিতে। জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করেন বলেও দাবি করেন তিনি। ছেলে আটকের ঘটনাটি তিনি স্থানীয় আমজাদ হাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইব্রাহিমসহ স্থানীয় নেতাদের জানিয়েছেন। এছাড়া ফুলগাজী থানার ওসি মাইন উদ্দিন মারুফ নামের এক মাদরাসা শিক্ষককে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আটক করার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে দীপন হত্যার ঘটনায় মুফতি জাহিদ হাসান মারুফকে আটকের কথা স্বীকার করেননি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
দীপন হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) মাসরুকুর রহমান খালেদ সাংবাদিকদের বলেন, কেউ আটক হওয়ার তথ্য তার কাছে নেই। তবে হয়তো অন্য কোনো মামলায় কেউ আটক হতে পারে।
অবশ্য তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রযুক্তির সহায়তা ও সোর্সের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তারা আরো ৭-৮ জনের সাথে মুফতি মারুফকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন।
মাসরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ভিডিও ফুটেজগুলো এখনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অনেক মানুষের সমাগম রয়েছে। তার মধ্যে থেকে কাদের সন্দেহজনক গতিবিধি ছিল তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। সন্দেহভাজনদের অবস্থান ও তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। নিশ্চিত হয়েই গ্রেফতার অভিযান চালানো হবে।
তিনি বলেন, খুনিরা ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে দীপনকে হত্যা করেছে। যে কারণে অপরাধের কোনো নমুনা রেখে যায়নি খুনিরা। তাই ক্লুলেস এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কিছুটা সময় লাগছে।
এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরো বলেন, সন্দেহভাজন ব্যক্তিসহ আজিজ সুপার মার্কেটে এলাকায় মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের কললিস্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। এতো বেশি কললিস্ট যে তার মধ্য থেকে এখন শর্ট আউট করা হচ্ছে। যা খুবই কষ্টসাধ্য।
তিনি বলেন, লেখক-ব্লাগার-প্রকাশক এবং ধর্মীয় ব্যক্তিদের হত্যাকাণ্ড একই ধরণের। এতে নিষিদ্ধ উগ্রপন্থী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) হত্যা মিশনের মিল রয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চলছে।
তবে একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দীপন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজনদের প্রাথমিক একটি তালিকা তৈরি করে অভিযান শুরু করেছে ডিবি।
মাশরুকুর রহমান খালেদ জানান, ভিডিও ফুটেজ ছাড়াও আরো সন্দেহভাজন রয়েছে। যাদের বিষয়ে গোয়েন্দারা খোঁজ খবর নিচ্ছে। একাধিক টিম কাজ করছে।
এদিকে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল শুক্রবার সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জানান, মুক্তবুদ্ধির লড়াইয়ে পিছু হটবেন না তিনি। এর আগে দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হওয়ার পর গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, বই প্রকাশ বন্ধ হবে না। মুক্তবুদ্ধির চর্চা বন্ধ হবে না। সেই কথাই আবারও যেন পুনর্ব্যক্ত করলেন তিনি।
সকাল ৯টার দিকে ফেসবুকে টুটুল লেখেন, শুভ সকাল বাংলাদেশ। শুভ সকাল মহাপৃথিবী। আবারো আঙ্গুল ছোঁয়া পেলো কী-বোর্ডের। এ যেন ঠিক বন্ধুদের সাথে হ্যান্ডশেক করার আনন্দ। বুদ্ধির মুক্তির লড়াইয়ে, মুক্তবুদ্ধির লড়াইয়ে আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব। সাথে থেকো বাংলাদেশ।
আহমেদুর রশীদ টুটুল, রণদীপম বসু ও তারেক রহিম বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। টুটুল ও রণদীপন বসুর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তারেক রহিমের দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে।
গত ৩১ অক্টোবর শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে এই তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় দুর্বৃত্তরা গুলিও করে। এতে শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, তারেক রহিম, রণদীপম গুরুতর আহত হন। একই দিন শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় তার প্রকাশনীর অফিসে ঢুকে দীপনকে নির্মমভাবে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যা নিশ্চিত করতে তাকে কুপিয়ে ভেতরে ফেলে রেখে অটোলক দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। দীপনের খোঁজ নেয়ার জন্য তার বাবা কয়েকবার ছেলেকে ফোন করেন। কিন্তু ছেলে ফোন ধরেননি। বিকের ৪টার দিকে তিনি ওই মার্কেটে ছেলের অফিসের সামনে যান। ওই সময় তিনি অফিসের দরজা খুলতে গিয়ে বন্ধ পান। এ সময় কাচের দরজা দিয়ে ভেতরে আলো জ্বলতে দেখেন। ছেলে বাইরে গেছে ভেবে তখন তিনি সেখান থেকে চলে যান। পরবর্তীতে লালমাটিয়া শুদ্ধস্বরে হামলার কথা শুনে বিকেল ৫টার দিকে লোকজন নিয়ে আবার ছেলের অফিসে গিয়ে দরজা ভেঙে দেখেন, দীপন রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ওই অবস্থায় ফয়সল আরেফিন দীপনকেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক সন্ধ্যা সাতটার দিকে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পরের দিন রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিহতের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রী মসজিদে নিহতের জানাজা শেষে আজিমপুরে লাশ দাফন করা হয়। গত মঙ্গলবার মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.