ভারতে মুক্ত বাকের ওপর হামলা by সোনিয়া ফ্যালেইরো

এম এম কালবুরগি
আজকের ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ উদার শক্তিগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে: জীবন কীভাবে বাঁচানো যায়।
এ বছরের আগস্ট মাসে ৭৭ বছর বয়সী পণ্ডিত এম এম কালবুরগিকে তাঁর বাড়ির দরজায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তিনি হিন্দুদের মূর্তিপূজার প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন। আবার গত ফেব্রুয়ারি মাসে কমিউনিস্ট নেতা গোবিন্দ পানসারেকে মুম্বাইয়ের কাছের একটি জায়গায় খুন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে নরেন্দ্র দাভোলকারকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতেন।
ভারতে মুক্ত বাকের ওপর সময় সময় হামলা হয়েছে, কিন্তু এবার ব্যাপারটা ভিন্ন মনে হচ্ছে। এই উৎপীড়নের খবর পত্রিকার প্রথম পাতায় এলেও সরকার সেটা স্বীকার করতে চায় না। বস্তুত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতাকে মৌন সম্মতি হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এসব হামলা বেড়ে গেছে, আর এ হামলার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে, যাদের চরম ডানপন্থী মতাদর্শ তিনি নিজেও ধারণ করেন।
এম এম কালবুরগি
এ মাসের শুরুর দিকে চরমপন্থী হিন্দুগোষ্ঠী শ্রীরাম সেনার এক নেতা এ উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। ইতিহাস বলে, এ গোষ্ঠী পানশালায় আক্রমণ চালিয়ে ভেতরে যে নারীদের পেয়েছিল, তাঁদের প্রহার করেছিল। তিনি সতর্ক করেছেন, যে লেখকেরা হিন্দু দেবতাদের অবজ্ঞা করেছেন, তাঁদের জিব কেটে নেওয়া হবে। যেসব মানুষ এই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর চূড়ান্ত লক্ষ্য, অর্থাৎ যঁারা হিন্দু জাতি প্রতিষ্ঠা সমর্থন করেন না, তাঁদের কাছে মোদির নীরবতার অর্থ অশুভ।
পাকিস্তানের উদার রাজনীতিক সালমান তাসির যখন ২০১১ সালে আততায়ীদের হাতে নিহত হন, তখন এম জে আকবর তিরস্কার করেছিলেন, ‘সালমান তাসির একজন ভারতীয় মুসলমান হলে আজ বেঁচে থাকতেন।’ সেই এম জে আকবর আজ বিজেপির সর্বভারতীয় মুখপাত্র। বাংলাদেশে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারত দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
ভারতে কী ঘটছে, সে ব্যাপারে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। আমাদের বুঝতে হবে, ভারত তার যে প্রতিবেশীদের সমালোচনা করে, তার অবস্থাও সেই তাদের মতো হতে পারে। মুম্বাইয়ের উদার সাংবাদিক নিখিল ওয়াগলে আমাকে বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া ভারত এক হিন্দু পাকিস্তান হবে’। ভারতের এ খুনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্লগার খুনের মিল রয়েছে। বাংলাদেশের ব্লগার হত্যা নিয়ে বিশ্বে শোরগোল হলেও ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ—এ সাইনবোর্ডের আড়ালে সে মুখ লুকাচ্ছে। খুন হওয়া ব্লগারদের মতো ভারতের এ নিহত মানুষগুলোও উদার দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁরা বিখ্যাত বা ক্ষমতাবান ছিলেন না।
সরকার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে আলাদাভাবে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করছে, কিন্তু মুক্ত বাকের ওপর যে সামগ্রিক হামলা হয়েছে, সেটা তারা আমলে নিচ্ছে না। এ হুমকি ও হত্যাকাণ্ড ভীতি সৃষ্টি করেছে, মানুষকে নিজে থেকেই বাক্সংযম করতে বাধ্য করছে। এ খুনিদের মধ্যে অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের এক হাতে বন্দুক, আরেক হাতে খুনের তালিকা। সাংবাদিক নিখিল ওয়াগলে একটি সূত্র থেকে জানতে পেরেছেন, ডানপন্থী হিন্দু গোষ্ঠী সনাতন সংস্থার ফোন টেপ করে জানা গেছে, গোষ্ঠীটি তাঁকে পরবর্তী শিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আগস্টে যারা কালবুরগিকে খুন করেছে, তারা আরও সরাসরি কাজ করে: গোষ্ঠীটি টুইটার বার্তা ব্যবহার করে অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কে এস ভাগওয়ানকে হুমকি দিয়েছে। তিনি ওদের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু। রাজনীতিকেরা নীরবতার মাধ্যমে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে হিন্দু জাতিতে পরিণত করার দুষ্কর্মে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তবে শুধু তারাই নয়, ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপিরও এতে অবদান রয়েছে।
গত কয়েক মাসে ভারতীয় সরকার দেশটির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষমুক্ত করে ফেলেছে, এর মধ্যে আছে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ও ইনডিপেনডেন্ট বোর্ড অব নালন্দা ইউনিভার্সিটি। সরকার মাঝারি মাপের লোকদের তাড়াচ্ছে না: নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। সরকার উজ্জ্বল নক্ষত্রদের সরিয়ে তাঁদের জায়গায় হিন্দুত্ববাদে আস্থাশীল লোকজনকে বসাচ্ছে। নব্য নিয়োগপ্রাপ্ত লোকজন বৈজ্ঞানিক চিন্তা বাদ দিয়ে ধর্মীয় চিন্তাকে বরণ করে নিচ্ছেন, ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে যার কোনো স্থান নেই।
ভারত সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, তাঁর আদর্শকে আঘাত করা। গত মাসে নয়াদিল্লির নেহরু জাদুঘর ও লাইব্রেরির পরিচালককে সরিয়ে দিয়ে সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তারা জাদুঘরটির নাম পরিবর্তন করতে চায়। তারা জাদুঘরটির মাজেজা বদলে দিতে চায়, চায় এটি মোদির অর্জনের ওপর আলো ফেলুক।
বিজেপির সাংসদ সাক্ষী মহারাজ মহাত্মা গান্ধীর খুনি নাথুরাম গডসেকে ‘দেশপ্রেমিক’ আখ্যা দিয়েছেন। যদিও পরবর্তীকালে মহারাজ নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, এ মতের সঙ্গে তাঁর অনেক সহযোদ্ধাই একমত পোষণ করেছেন। গান্ধীর খুনি সশস্ত্র হিন্দু গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের একজন সাবেক সদস্য, যে গোষ্ঠীর সঙ্গে মোদি তাঁর আট বছর বয়স থেকেই যুক্ত। এই যে বিজেপি ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ ধারণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বদলে দিতে চাইছে, সেটা কিন্তু আগেভাগেই বোঝা গেছে। এ মূল্যবোধকে বিজেপি ‘পশ্চিমা’ বলে খারিজ করে। ফলত, সংস্কৃতি ও পর্যটনমন্ত্রী মহেশ শর্মা যখন বলেন, ‘গণবিতর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রকে পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত করা হবে’, তখন বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
গত ডিসেম্বরে প্রথিতযশা লেখক পেরুমাল মুরুগান পুলিশকে বলেছিলেন, ২০১০ সালে লেখা তাঁর এক উপন্যাসের কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো তাঁকে হুমকি দিয়েছে। চরমপন্থীরা প্রকাশ্যেই তাঁর বই পুড়িয়েছে, দাবি করেছে, তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে। পুলিশ তাঁকে নির্বাসনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তিনি যে একা তা বুঝতে পেরে এ বছরের জানুয়ারিতে মুরুগান নিজের সাহিত্যকর্ম প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন। ফেসবুকে তিনি লেখালেখি ছেড়ে দেওয়ার শপথ জানান দেন। বস্তুত, তিনি পরিবারের নিরাপত্তার ভয়ে এ ঘোষণা দেন, যার শানে নজুল হচ্ছে তিনি নিজের সাহিত্যকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন।
ভারতে যা ঘটছে, তা মেনে নেওয়া কঠিন। বিজেপি যত দিন আছে, তত দিন এ হামলা ও হুমকি থাকবে। অথবা এটাকে উদারনীতিক মানুষ হত্যার কাল বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ভারতে যে মারাত্মক পরিবর্তন ঘটছে, তার প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হবে।
ভারতের এ হামলাগুলো যে উদার লেখক ও ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ব্যাপারটা তা নয়। এগুলো গণতন্ত্রের হৃদ্যন্ত্রের ওপর হামলা। ভারতের জন্মকালীন মূল্যবোধকে যাঁরা মূল্যায়ন করেন, তাঁদের কাছে এটা উদ্বেগের ব্যাপার। যে মূল্যবোধের কারণে মানুষ ভারতকে ভালোবাসে, এটা ধর্মান্ধদের ভারত নয়। সব মতকেই রক্ষা করার আওয়াজ দিতে হবে, নিজেদের মত হারানোর আগেই।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া
সোনিয়া ফ্যালেইরো: ভারতীয় সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.