সিরিয়ার মধ্যপন্থীরা গেল কোথায়? by রবার্ট ফিস্ক

রুশ বিমান হামলায় বিধ্বস্ত সিরিয়ার কয়েকটি ভবন
সিরিয়ার আকাশসীমা পশ্চিমের কাছে অলীক বস্তু, রাশিয়ার বিমানবাহিনী সেখানে সরাসরি ঢুকে গেছে। আমাদের বলা হয়েছে, রাশিয়া সিরিয়ার ‘মধ্যপন্থীদের’ ওপর বোমা হামলা চালাচ্ছে। যে ‘মধ্যপন্থীদের’ অস্তিত্বের কথা যুক্তরাষ্ট্র দুই মাস আগেও স্বীকার করেছিল, তারা আর নেই।
এটা অনেকটা আইসিস যোদ্ধাদের মতো, যারা ‘খিলাফতের’ জন্য লড়াই করতে ইউরোপ ত্যাগ করেছে। পাঠক, তাদের কথা মনে আছে? বড় জোর দুই মাস আগের কথা, আমাদের রাজনৈতিক ও প্রথম সারির লেখকেরা ‘দেশের ভেতরে বেড়ে ওঠা’ ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, যারা আইসিসের মতো দানবের হয়ে লড়াই করতে ব্রিটেন, আমেরিকাসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ ত্যাগ করছিল। তারপর আমরা দেখলাম, লাখ লাখ শরণার্থী বলকান এলাকা হয়ে ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছে, মাঝপথে তারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকিও নিয়েছে। আর সেই একই রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, আমাদের শঙ্কিত হওয়া উচিত, কারণ এই শরণার্থীদের মধ্যে আইসিসের খুনিরা আছে।
ইউরোপীয় মুসলমানেরা আইসিসে যোগ দেওয়ার জন্য যেভাবে তুরস্কে আসছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। কয়েক সপ্তাহ পরেই সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় তাদের নৌকা ফুটো হয়ে যাওয়ায় তারা ডুবে মরেছে অথবা ধীর পায়ে দেশে ফিরে গেছে। কেউ কেউ আবার হাঙ্গেরি থেকে ট্রেন ধরে জার্মানিতে গেছে। কিন্তু এই বাজে কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ইউরোপে ফিরে যাওয়ার পর তারা আমাদের ওপর হামলা চালানোর মতো সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় পেল কোথায়?
আবার এমনও হতে পারে যে ব্যাপারটা স্রেফ গল্প। এর বিপরীতে গত সপ্তাহে সিরিয়ায় রাশিয়ার নির্মম বিমান হামলা যে ভীতি সৃষ্টি করেছে, তা রীতিমতো অসুস্থতার শামিল।
আসুন, বাস্তব পরিস্থিতিটা পরীক্ষা করেই শুরু করি। হামলাকারী রুশ সেনাবাহিনী খুনি। তারা চেচনিয়ায় ইসলামপন্থীদের উত্থান রোধ করতে সেখানকার নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, আর এবার তারা বাশার আল-আসাদের সরকারকে রক্ষা করতে এবং এই নব্য ইসলামপন্থীদের প্রতিহত করতে সিরিয়ার নিরীহ মানুষকেও হত্যা করবে। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অনেকেই যুদ্ধাপরাধী, তারা রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হিংস্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, সেটা করতে গিয়ে তারা ব্যারেল বোমাও ব্যবহার করেছে। সিরিয়ার জন্য তারা আবার জীবনও দিয়েছে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর অতি প্রিয় ‘মার্কিন কর্মকর্তারা’ দাবি করেছেন, সিরিয়ার সেনাবাহিনী আইসিসের বিরুদ্ধে লড়ছে না। সেটা যদি সত্য হয়, তাহলে সিরিয়ার ৫৬ হাজার সেনাকে কারা হত্যা করেছে? এই পরিসংখ্যানের দাপ্তরিক গোপনীয়তা থাকলেও তা সত্য, সিরিয়ার যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কারা মারা গিয়েছে? সেই উদ্ভট ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ)?
সিরিয়ার ‘মধ্যপন্থীদের’ নিয়ে যে প্রায়ই বীরগাথা রচিত হচ্ছে, তার মধ্য দিয়েই এই বাজে ব্যাপারটি চরমে পৌঁছেছে। এরা মূলত ছিল এফএসএর দলত্যাগী সদস্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের সম্ভাব্য পশ্চিমমুখী শক্তি মনে করেছিল, যাদের সিরিয়ার সরকারি সেনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এই এফএসএ খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়, এরা ছিল দুর্নীতিবাজ। আর সেই ‘মধ্যপন্থীরা’ আবারও দলত্যাগ করে ইসলামিস্ট নুসরা ফ্রন্ট ও আইসিসে যোগ দেয়। তারা মার্কিনদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রগুলো সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রি করে দেয় অথবা নীরবে গ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করে—বিচক্ষণতার সঙ্গেই। সেখানে তারা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু চেক পয়েন্ট বসিয়েছে।
রুশ বিমান হামলায় বিধ্বস্ত সিরিয়ার কয়েকটি ভবন
ওয়াশিংটন স্বীকার করে, তারা লাপাত্তা হয়ে গেছে, তাদের দুর্ভাগ্যে শোকও প্রকাশ করে। ওয়াশিংটন সিদ্ধান্তে আসে, তাদের নতুন ‘মধ্যপন্থী’ দরকার। সে লক্ষ্যে তারা সিআইএকে দিয়ে ৭০ জন যোদ্ধাকে এই গ্রীষ্মে সশস্ত্র ও প্রশিক্ষিত করে তুরস্ক সীমান্ত দিয়ে সিরিয়ায় ঢুকিয়ে দেয়। তাদের মধ্যে ১০ জন ছাড়া বাকি সবাই নুসরা ফ্রন্টের হাতে ধরা পড়ে, আর তাদের মধ্যে অন্তত দুজনকে হত্যা করা হয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে আমি নিজে শুনেছি, ইরাকে যে জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তারা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ঊর্ধ্বতন একজন ঘোষণা দিয়েছেন, ‘মধ্যপন্থীরা অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে।’ কেউ কি এখন তাদের দেখতে পায়? না, দেখতে পায় না।
কিন্তু রাশিয়া সিরিয়ায় হামলা চালানো শুরু করার পর ওবামা প্রশাসন, নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন ও বৃদ্ধ বেচারা বিবিসি সেই ভূতকে পুনর্জাগ্রত করল! রুশরা সাহসী ‘মধ্যপন্থীদের’ ওপর হামলা শুরু করেছে, যারা বাশারের সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। অথচ তারাই
কয়েক সপ্তাহ আগে বলেছিল, এই মধ্যপন্থীদের অস্তিত্ব নেই।
এখন কিছু মামুলি তথ্য দিই। রাশিয়ার বিমানবাহিনীর হামলার লক্ষ্যবস্তুর তালিকা তৈরি করে দিচ্ছে সিরিয়ার সেনাবাহিনী, কিন্তু সিরিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের নিজস্ব শত্রু রয়েছে।
রাশিয়া যে প্রথম বিমান হামলাটি চালায়, সেটা মার্কিনদের কথিত ‘মধ্যপন্থীদের’ ওপর নয়। সেই হামলাটি তারা চালিয়েছিল সিরিয়ার দূর উত্তর-পশ্চিমে, যে গ্রামটি বহুদিন ধরে চেচেন যোদ্ধাদের দখলে ছিল। এরা কিন্তু সেই চেচেন, যাদের পুতিন খোদ চেচনিয়াতেই খতম করে দিতে চেয়েছিলেন। এই চেচেন সেনারা গত বছর সিরিয়ার কৌশলগত সামরিক স্থাপনা পজিশন ৪৫১-তে হামলা চালিয়েছিল, ফলে বাশারের সেনাবাহিনী যে সেটাকে লক্ষ্যবস্তুর তালিকায় রেখেছিল, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
রাশিয়ার অন্যান্য হামলার লক্ষ্যবস্তু আইসিস ছিল না, ছিল একই এলাকায় অবস্থানরত জয়েশ আল-শামস বাহিনী। কিন্তু প্রথম ২৪ ঘণ্টায় রাশিয়া পালমিরার ওপরে পর্বতের মধ্য দিয়ে আইসিসের সরবরাহ লাইনের ওপরও বোমা বর্ষণ করেছে।
রাশিয়ার বিমানবাহিনী সুনির্দিষ্টভাবে সালামিয়া শহরের আশপাশের মরু সড়কে হামলা চালিয়েছে। মে মাসে আইসিসের আত্মঘাতী বাহিনীর গাড়িবহর এ পথেই পালমিরায় গিয়ে সিরিয়ার বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। তারা হাসাকের আশপাশে ও আইসিস-নিয়ন্ত্রিত রাকা বিমানঘাঁটিতেও হামলা চালিয়েছে। সিরীয় বাহিনী গত বছর রাকায় আইসিসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে (আত্মসমর্পণের পর তাদের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে)।
সিরিয়ায় রাশিয়ার যে স্থলসেনা রয়েছে, তারা শুধু ঘাঁটি পাহারা দিচ্ছে। তাদের উপস্থিতি প্রতীকী, কিন্তু তারা আইসিসের সঙ্গে লড়াই করবে, এমন চিন্তা মিথ্যা। রাশিয়া চায়, তাদের জায়গায় সিরিয়ার সেনাবাহিনী মাঠে লড়াই করে মরুক। না, সিরিয়ার যুদ্ধে ভালো বা খারাপ মানুষের বালাই নেই। বেসামরিক মানুষ হত্যার ব্যাপারে সিরিয়ার সেনা ও ন্যাটোর চেয়ে রাশিয়ার সংবেদনশীলতা বেশি নয়। সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে ছবি বানানো হলে তার নাম হওয়া উচিত ওয়ার ক্রিমিনালস গ্যালোর!
কিন্তু দোহাই আপনাদের, আকাশকুসুম কল্পনা করা বন্ধ করুন। দিন কয়েক আগে হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, রাশিয়ার বোমাবর্ষণের কারণে ‘মধ্যপন্থীরা চরমপন্থীদের খপ্পরে পড়ছে’।
এ গল্প কে লিখছে? হয়তো একজন ‘মধ্যপন্থীই’ বটে...
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা।

No comments

Powered by Blogger.