কূটনৈতিক এলাকায় বিজিবির টহল

রাজধানীর গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায়
গতকাল রাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)
সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। ছবিটি জাতিসংঘ
সড়ক থেকে তোলা l আশরাফুল আলম
যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের জন্য সতর্কবার্তা জারির পরদিন গতকাল শনিবার রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায়।
যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের লক্ষ্য করে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা জানিয়ে গত শুক্রবার বাংলাদেশে ভ্রমণবিষয়ক সতর্কবার্তা হালনাগাদ করে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানান, কূটনৈতিক এলাকায় বিজিবি ও সোয়াতের টহলের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যা থেকে আজ রোববার ভোর পর্যন্ত ওই এলাকায় নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি টহল দেয়। এ ছাড়া বিকেলে গুলশান, বারিধারা ও উত্তরা এলাকায় গাড়ি ও মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও পুলিশের সোয়াত টিম।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, গুলশান ও বারিধারার বিভিন্ন সড়কে নিরাপত্তার জন্য নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সোয়াত ও বিজিবি টহল দেবে। তারা মূলত পুলিশকে সহায়তা করবে। এ ছাড়া বিদেশিদের নিরাপত্তা জোরদার করতে সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার পর সরকার কূটনীতিকসহ বাংলাদেশের সব বিদেশির নিরাপত্তা জোরদার করেছে। ইতালি ও জাপানের দুই নাগরিক হত্যার তদন্তে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশিদের নিরাপত্তায় যা যা দরকার, সরকার সবকিছুই করবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আশ্বাসের পর তিন দিন পেরিয়ে গেলেও পশ্চিমা দেশগুলো তাদের ভ্রমণবার্তা শিথিল করেনি। উল্টো দুই মন্ত্রীর আশ্বাসের তিন দিনের মাথায় ভ্রমণবিষয়ক সতর্কবার্তা আরও জোরালো করেছে যুক্তরাজ্য।
গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত যুক্তরাজ্য গত শুক্রবারের ভ্রমণবিষয়ক সতর্কবার্তাটি বহাল রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ১ অক্টোবর এবং অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও কানাডাও তাদের ৪ অক্টোবরের বার্তাটি গতকাল পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। এ ছাড়া আয়ারল্যান্ডের দেওয়া গত ২৯ সেপ্টেম্বরের বার্তাটি সর্বশেষ সতর্কতা হিসেবে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এ দেশগুলো বাংলাদেশে চলাফেরার সময় তাদের নাগরিকদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে।
পুলিশের টহল: গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে গুলশান ১ নম্বরে শুটিং ক্লাবের মোড় থেকে পুলিশি টহল শুরু হয়। সেখান থেকে গুলশান ১, গুলশান ২-এর চৌরাস্তা এবং ওই এলাকার ৭৯ ও ৭৮ নম্বর সড়ক হয়ে বারিধারা পেরিয়ে উত্তরা হয়ে রাত আটটার দিকে কূটনৈতিক এলাকায় টহল শেষ হয়।
টহল চলার মধ্যবর্তী সময়ে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মাদানি অ্যাভিনিউতে মার্কিন দূতাবাসের সামনে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে বক্তব্য দেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) শেখ মুহম্মদ মারুফ হাসান। তিনি বলেন, সম্প্রতি সন্ত্রাসীরা ইতালির একজন নাগরিককে হত্যা করেছে। এ নিয়ে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য ডিএমপি বিভিন্ন সড়ক ও চেকপোস্টে টহল জোরদার করেছে। আমরা বিদেশিদের ভীতি দূর করতে চাই, তাঁরা স্বাভাবিকভাবে দৈনন্দিন কাজ করুক, সেটিও চাই। এ জন্য বাড়তি সতর্কতার দরকার নেই। কারণ, এ মুহূর্তে আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। সে জন্যই যৌথ এই নিরাপত্তা মহড়ার আয়োজন করা হয়েছে।
পুলিশি টহলের সময় অন্যদের মধ্যে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা পুলিশ) মনিরুল ইসলাম ও গুলশান বিভাগের উপকমিশনার এস এম মোস্তাক আহমেদ খানসহ পুলিশের এক শর মতো সদস্য অংশ নেন। টহল শুরুর আগে শুটিং ক্লাব থেকে গুলশান ১ নম্বরের দিকের সড়কের পূর্ব পাশের লেনের কিছু অংশে সাধারণ যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
ছোটখাটো হামলার ঝুঁকি: বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি জাস্টিন রোলাটের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ছোটখাটো সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। আতঙ্ক ছড়ানো আর স্বাভাবিক জীবন থামিয়ে দিতে এসব ছোটখাটো হামলা যে কতটা কার্যকর হতে পারে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দুই হত্যা সেটি দেখিয়েছে।
গত শুক্রবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে জাস্টিন রাউল্যাট ওই দুই হত্যায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দাবি এবং সরকার এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ঠেকানোর ক্ষেত্রে সরকারের কাঠখড় পোড়ানো এবং এ বছর চারজন ব্লগারকে হত্যার কথাও এসেছে। সাম্প্রতিক হামলাগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করতে পারে বলে মত দেওয়া হয়েছে।
বিবিসির ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলাগুলোতে বিক্ষিপ্তভাবে বিদেশিদের বেছে নেওয়া হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, বাংলাদেশে ভ্রমণকারী যে কেউ হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন। তাবেলার ওপর হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই দূতাবাসগুলো সর্বোচ্চ সতর্কতার উল্লেখ করে ভ্রমণবার্তা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই দুই-তৃতীয়াংশ পর্যটক বাংলাদেশে তাঁদের বুকিং বাতিল করেছেন। সাহায্য সংস্থাগুলো তাঁদের কর্মীদের চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতাদের অনেকে আতঙ্কের কারণে বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছেন। আর অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশে পূর্বনির্ধারিত সফর বাতিল করেছে।
বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি সরকার অস্বীকার করে আসছে। এ ছাড়া দুই হত্যায় আইএসের দাবি প্রমাণিত হয়নি। তবে হত্যায় যারাই জড়িত হোক না কেন, এর ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
‘নতুন ভ্রমণ সতর্কতা রুটিন অ্যাডভাইজরি’: বাসস জানায়, ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশন গতকাল বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট যুক্তরাজ্যের নতুন ভ্রমণ পরামর্শকে একটি রুটিন আপডেট (নিয়মিত হালনাগাদ) হিসেবে বর্ণনা করেছে। কমিশন বলেছে, এতে কোনো নিরাপত্তাঝুঁকি বৃদ্ধির বিষয় উল্লেখ করা হয়নি।
ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনের একজন মুখপাত্র যুক্তরাজ্য সরকার নতুন ভ্রমণ পরামর্শ দেওয়ার এক দিন পর গতকাল বাসসকে বলেছেন, বাংলাদেশে ভ্রমণকারীদের জন্য এটি ছিল তাদের নিয়মিত পরামর্শের আপডেট। নতুন এই পরামর্শে ব্রিটিশ নাগরিকদের বাংলাদেশ সফরে আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে কি না, এ রকম প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, ‘অবশ্যই না’।
ব্রিটিশ হাইকমিশনের আরেকজন কর্মকর্তা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষ বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে তাদের নাগরিকদের সব সময় নিয়মিত হালনাগাদ পরামর্শ দিয়ে থাকে। এটি তাদের বিদেশ সফরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক।

No comments

Powered by Blogger.