বাংলাদেশও নোবেল পেতে পারতো

নোবেলের ইতিহাস এ দেশে সুখকর নয়। নোবেলজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সারা পৃথিবীতে একটি সম্মানিত নাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বাড়ির পাশে ভারত- কোথায় তিনি পূজনীয় হননি। নিজ দেশ বাংলাদেশের গল্প অবশ্য আলাদা। তবে শনিবার যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হলো তখন বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে আপসোস। একটি কথাই উচ্চারিত হচ্ছে বারবার- বাংলাদেশও নোবেল পেতে পারতো।
কেন এই আপসোস? এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছে- তিউনিশিয়ার চারটি সংগঠনের জোট ‘ন্যাশনাল ডায়ালগ কুয়ার্টেট’। সংলাপের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্যই মূলত এ পুরস্কার পেয়েছে জোটটি। ২০১৩ সালে তিউনিশিয়ায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যখন ধ্বংসের ঝুঁকিতে ছিল তখন এ জোটটি গঠিত হয়। গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়া তিউনিশিয়ায় একটি বিকল্প শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করে এই জোট। নোবেল শান্তি পুরস্কার তিউনিশিয়ার গণতন্ত্রকে আরও সংহত করতে অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেছে নোবেল কমিটি।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, খুব সম্ভবত, বাংলাদেশের সামনেও সুযোগ ছিল এ পুরস্কার জয়ের। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশও ছিল রক্তাক্ত। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথ ছিল উত্তপ্ত। সংকট সমাধানে উদ্যোগী হন জাতিসংঘের মহাসচিব বান-কি মুন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দফায় দফায় ফোনে কথা বলেন তিনি। তার দূত হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৭ই ডিসেম্বর ঢাকা সফরে আসেন তারানকো। ১২ই ডিসেম্বর ঢাকা ত্যাগ করার আগে তিনি দুই নেত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। তার উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেও সংলাপ হয়। যে সংলাপে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আওয়ামী লীগের পক্ষে আরও ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও গওহর রিজভী। অন্যদিকে, বিএনপির পক্ষে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলটির নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান ও শমসের মবিন চৌধুরী। অসমর্থিত একটি সূত্রের দাবি, সে বৈঠকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রায় সমঝোতায় পৌঁছে গিয়েছিল। তবে উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে আলোচনা থেমে যায়। যদিও ওই বৈঠকে আসলে ঠিক কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোন পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কখনও কিছু বলা হয়নি। হয়তো গোপনীয়তা রক্ষার কোন প্রতিশ্রুতির কারণেই তা করা হয়নি। ওই সফরে নাগরিক সমাজের সঙ্গেও বৈঠক করেছিলেন তারানকো। ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. শাহদীন মালিক ও বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে বৈঠক করেন তারানকো। তবে তার সমঝোতা প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। একপক্ষীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরে কয়েক দফায় তারানকোর বাংলাদেশ সফরের কথা শোনা গেলেও তিনি আর আসেননি। দৃশ্যত বাংলাদেশ সরকারের অনীহার কারণেই তিনি আর আসতে পারেননি।
বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ কয়েক দফায় সংলাপের উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয়নি। উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের সমঝোতা প্রচেষ্টা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সমালোচনার মুখে মুখ থুবড়ে পড়ে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তারানকো বা নাগরিক সমাজের উদ্যোগ যদি সফল হতো তবে বাংলাদেশও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের অন্যতম দাবিদার হতো। সুুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, নোবেল কমিটি নাগরিক উদ্যোগকে যে স্বীকৃতি দিয়েছে তাতে আমরা আনন্দিত। নাগরিকরা সক্রিয় না থাকলে গণতন্ত্র আসে না, গণতন্ত্র আসলেও তা থাকে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সংকটের সমাধানে আমরা চেষ্টা করেছি। আমরা বারবারই সংলাপ-সমঝোতার আহ্বান জানিয়ে আসছি। এ জন্য আমাদের আক্রমণ করা হয়েছে, হেয় করা হয়েছে। তবুও আমরা বলি সংলাপ ছাড়া কোন সংকটের সমাধান হয় না।
ড. শাহদীন মালিক অবশ্য মনে করেন তিউনিশিয়ার নাগরিক সমাজ যতবড় ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের তেমন ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে পুলিশি অসদাচরণ ও দুর্নীতির প্রতিবাদে এক তরুণের আত্মাহুতির ঘটনার মধ্য দিয়ে তিউনিশিয়ায় আরব বসন্তের সূত্রপাত হয়। দ্রুতই সেই আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। পরের বছর জানুয়ারিতে দেশটির স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট জিনে আল আবিদিন বেন আলির ২২ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। মার্কিন সাংবাদিক এন্ডি কারভিন তিউনিসিয়ার জাতীয় ফুলের নামে ওই গণবিপ্লবের নাম দেন ‘জেসমিন বিপ্লব’। পরে নামটি বিশ্বজুড়ে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। নোবেল কমিটির ঘোষণায় বলা হয়, ‘ওই আরব বসন্ত দ্রুতই উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ওই দেশগুলোর অনেকগুলোতে এখন গণতন্ত্র আর মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াই থমকে গেছে বা বাধার সম্মুখীন হয়েছে। তবে তিউনিশিয়া প্রাণবন্ত একটি সমাজের ওপর ভিত্তি করে গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রত্যক্ষ করেছে। যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর সম্মান প্রদর্শনের দাবি ছিল। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে তিউনিশিয়ার ন্যাশনাল ডায়ালগ কুয়ার্টেট। এ জোটভুক্ত সংগঠনগুলো হচ্ছে- তিউনিশিয়ান অর্ডার অব ল’ইয়ার্স, তিউনিশিয়ান জেনারেল লেবার ইউনিয়ন, তিউনিশিয়ান কনফেডারেশন অব ইন্ডাস্ট্রি, ট্রেড অ্যান্ড হ্যান্ডিক্র্যাফটস এবং তিউনিশিয়ান হিউম্যান রাইটস লীগ।
আরব বসন্তের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শুধু তিউনিশিয়াই তাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে পেরেছে। লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন যুদ্ধবিধ্বস্ত। মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম সরকারকে ২০১৩ সালে উৎখাত করে দেশটির সেনাবাহিনী। নোবেল কমিটি বলেছে, তিউনিশিয়ান ন্যাশনাল ডায়ালগ কুয়ার্টেট-এর সংগঠনগুলো তিউনিশিয়ার সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র ও আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে। এর মধ্যে রয়েছে কর্মশীল জীবন, সমাজকল্যাণ, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের নানা মূল্যবোধ। এর ভিত্তিতে তারা অসাধারণ নৈতিক কর্তৃত্ব সহকারে দেশটিতে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা এগিয়ে নিয়ে যেতে মধ্যস্থতাকারী ও চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে। আরও বলা হয়, তিউনিশিয়ার অভ্যুত্থান শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে রূপ নেয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল কুয়ার্টেটের। তারা রাজনৈতিক দলগুলো, কর্তৃপক্ষ এবং নাগরিকদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সংলাপের পথ উন্মোচন করে দেয়। কুয়ার্টেট ব্যাপক পরিসরে যে জাতীয় সংলাপ প্রক্রিয়া চালু করতে সক্ষম হয়েছিল তা তিউনিশিয়াজুড়ে সহিংসতা কমিয়ে আনতে সফল হয়। কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক বেন আলির পতনের পর গণতন্ত্রের পথে তিউনিশিয়ার উত্তরণের ঘটনাপ্রবাহ বেশ কয়েকটি কারণে স্বতন্ত্র এবং নজিরবিহীন। প্রথমত, এতে প্রতীয়মান হয়েছে, ইসলামপন্থি ও ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনগুলো দেশের সর্বোত্তম স্বার্থের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে পারে। ফলে, তিউনিশিয়ার উদাহরণ সংলাপের গুরুত্ব নতুন করে তুলে ধরে। দ্বিতীয়ত, তিউনিশিয়ায় পরিস্থিতির উত্তরণে স্পষ্ট হয় যে, সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের গণতন্ত্রকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এমন একটি প্রক্রিয়া কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে। নোবেল কমিটি বলেছে, এ অর্জনের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দিতে হবে ন্যাশনাল ডায়ালগ কুয়ার্টেটকে। কৃতিত্ব এ জন্য দিতে হবে যে জেসমিন বিপ্লবের সুফল হারিয়ে যায় নি। ঘোষণার শেষে বলা হয়, তিউনিশিয়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। নোবেল কমিটির প্রত্যাশা এ বছরের পুরস্কার দেশটির গণতন্ত্র রক্ষায় অবদান রাখবে। আর মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও বিশ্বের অন্য স্থানগুলোতে যারা শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রচারণায় কাজ করছেন এটা হবে তাদের জন্য অনুপ্রেরণা। সর্বোপরি এটা তিউনিশিয়ার জনগণকে উৎসাহ যোগাবে বলে উল্লেখ করে নোবেল কমিটি।

No comments

Powered by Blogger.