শিক্ষকের অমর্যাদা এবং সমাজের অন্ধকার by শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল

সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা, একজন কলেজ অধ্যাপককে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে, ৯ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে বাক-বিতণ্ডাকে কেন্দ্র করে পিরোজপুর ভাণ্ডারিয়া সরকারি কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষের কক্ষে অধ্যক্ষ ও ইউএনও’র উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে সহকারী অধ্যাপক মোনতাজ উদ্দিনকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পা ছুঁয়ে ক্ষমা চেয়ে নিজেকে রক্ষা করতে হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে, সহকারী অধ্যাপক মোনতাজ উদ্দিনের পাঁচ বছরের জুনিয়র সহকারী কমিশনারের (ভূমি) (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাওয়াটা সহজেই মেনে নিতে পারছিলেন না বলেই, তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছরের মেয়ের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠতেই তিনি তার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করেন। আমরা সাধারণত কোনো সন্তান যদি তার মায়ের সঙ্গে কিংবা কোনো বখাটে ছেলে যদি কোনো ভদ্র মহিলার সঙ্গে বেয়াদবি করে, তখন আমরা বলে থাকি যে, সেই বেয়াদব বখাটে ছেলেটা কি কোনো মায়ের গর্ভে জš§গ্রহণ করেনি? ঠিক তেমনি কোনো আমলা যদি তার শিক্ষা-দীক্ষার নৈতিক অহংকার বিসর্জন দিয়ে কোনো শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদবি করে কিংবা কোনো শিক্ষককে যদি নিজের পা ধরিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন তখন কেউ যদি বলে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কি কোনো শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেননি। যে শিক্ষিত লোক একজন শিক্ষকের সঙ্গে চরম বেয়াদবি করেন, তিনি তো শিক্ষিত সমাজে বসবাস করার যোগ্যতাই রাখেন না। আর যাদের সামনে কিংবা যারা একজন অধ্যাপককে একজন এসি ল্যান্ডের পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছেন তারা তো এই দায় এড়াতে পারেন না। ইউএনও এবং কলেজ অধ্যক্ষের অর্থাৎ যাদের সামনে সহকারী অধ্যাপককে এসি ল্যান্ডের পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছে, তাদেরও হতে হবে। কেননা তাদের উপস্থিতিতেই কিংবা বলা যায় তারাই সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন শিক্ষককে এসি ল্যান্ডের পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছেন। শুধু লেখাপড়া করে বড় চাকরি নিলেই যে ভদ্রলোক হওয়া যায় না, তার প্রমাণ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যকলাপ। লেখাপড়া না করেও ভদ্রলোক হওয়া যায়। অনেক সময় দেখা যায় লেখাপড়া না করে, রিকশা-সিএনজি চালিয়েও অনেক মননশীল, আত্মমর্যাদাশীল মানুষ হওয়া যায়। আমাদের সমাজে এমন মানুষও বাস করেন, যারা মানুষের মঙ্গল কামনা করে থাকেন। আবার বিএ, এমএ অর্থাৎ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাস করেও ভদ্রলোক হওয়া যায় না। ছোটকাল থেকেই শুনে এসেছি ভদ্রলোক হতে হলে, জ্ঞানের পবিত্র জলে তিন পুরুষের রক্ত ধৌত হয়ে পরিষ্কার হতে হয়। আগে নাকি চাকরি দেয়া হতো বংশের মর্যাদা দেখে। এ কথা কখনো বিশ্বাস করতাম না যে, তিন পুরুষ শিক্ষিত না হলে ভদ্রলোক হওয়া যায় না। এখন কিছু কিছু শিক্ষিত মানুষের কর্মকাণ্ড দেখে কেন জানি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে, তিন পুরুষ শিক্ষিত না হলে ভদ্রলোক হওয়া যায় না। এখানে যে কথা বলতে চাই, তা হলো শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মতোই আচরণ করতে হবে। তারা যদি অশিক্ষিত বর্বরদের মতো আচরণ করেন তাহলে আর মানুষ যাবে কোথায়। এখানে আরেকটি কথা বলতে চাই, একজন মানুষের কর্মকাণ্ড দিয়ে হয়তো বা সবকিছুর বিচার করা যায় না। ভদ্রলোক হতে হলে তিনপুরুষ শিক্ষিত হতে হবে, এটা বিশ্বাস করতে চাই না। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তিই চান নিজেকে সুন্দরভাবে সমাজে উপস্থাপন করতে। করেও থাকেন। দু’একজন ব্যক্তির বর্বর কর্মকাণ্ডকে আমরা ধরে নিতে পারি কোনো বাঁদরের বিশেষ কর্মকাণ্ড। ফুলের বাগানে যদি কোনো বাঁদরকে ছেড়ে দেয়া হয়, সেই বাঁদর কি আর ফুলের বাগানের মূল্য বুঝবে। বাঁদরের কাছ থেকে তো আর মানুষের আচরণ আশা করা যায় না। আশা করাটাও বোকামি। যখন মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিরা অশিক্ষিত লোকের মতো আচরণ করবেন তখন একজন হৃদয়বান ব্যক্তি রাগে ক্ষোভে, অভিমানে বলতেই পারেন, অমানুষের মতো আচরণ করা লোকটির পারিবারিক ঐতিহ্যই বা কী। একজন ভালো বংশের মানুষ তিনি যতই দরিদ্র কিংবা কম লেখাপড়া জানা হোন না কেন, তিনি কিন্তু মানুষই থাকেন। তার কাছ থেকে মানুষের আচরণই মানুষ পেয়ে থাকে। একজন অধ্যাপককে অপমানকারী ব্যক্তিরা কি জানেন না একজন শিক্ষক হলেন সমাজের মানুষ গড়ার কারিগর? অর্থাৎ একজন শিক্ষককে যখন কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি বা আমলা তার পা ছুঁয়ে মাফ চাইতে বাধ্য করবেন, তখন একজন হৃদয়বান ব্যক্তি বলতেই পারেন, উনি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে অভদ্রের মতো আচরণ করলেন কেন। তার পরিবার থেকে কি তিনি এই শিক্ষা পাননি যে, একজন শিক্ষকের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়। কিংবা তার পরিবারের মধ্যে কি তিনি একাই শিক্ষিত ব্যক্তি। এমন প্রশ্ন কিংবা বক্তব্য যখন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের মনে আসবে কিংবা কেউ যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক বক্তব্য প্রদান করে, তখন কি সেই মানুষদের দোষ দেয়া যাবে। একজন আমলা যদি মনে করেন যে উনিই সমাজের সর্বেসর্বা, তাহলে বিরাট ভুল করবেন। কেননা সমাজের মানুষ এখন অনেক অগ্রগামী চিন্তা-চেতনা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ কথাটাও আমলাতান্ত্রিক সমাজের কর্তাব্যক্তিদের জেনে রাখা উচিত। এখন কেউ কারো প্রজা নয়। পরিশেষে আরেকটি কথা বলতে চাই, একজন বিসিএস ক্যাডারের লোককে আজকালের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র প্রাঙ্গণে লেখাপড়া করে আসতে হয়। প্রশ্ন হলো সংশ্লিষ্ট এসি ল্যান্ড অর্থাৎ অভিযুক্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেও এই শিক্ষা পাননি যে, একজন শিক্ষকের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়? জানতে বড় ইচ্ছে করে, এটা কি তার ব্যর্থতা নাকি আমাদের সমাজের দলবাজি রাজনীতির ভয়াবহ চেহারা?
লেখক : আইনজীবী

No comments

Powered by Blogger.