সিএমপি নিজের কাজে কতটা সফল? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

শত শত যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায়। গণপরিবহনের অপেক্ষা। কিন্তু বাস-মিনিবাস-টেম্পোর দেখা নেই। ষোলোশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় নারী-শিশুসহ নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষের এই দুর্ভোগের সময়টাতে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল। গাড়ি থেকে নেমে এলেন তিনি। মানুষের সঙ্গে কথা বললেন। তাঁদের দুরবস্থার বিবরণ শুনে তাৎক্ষণিক পুলিশের একটি বাস দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। এরপর রমজান মাসজুড়ে যাত্রীদের দুরবস্থা লাঘবের কথা বিবেচনা করে বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ষোলোশহর থেকে বারিক বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত বিনা মূল্যে যাত্রী পরিবহনের জন্য পুলিশের দুটি বাস দিলেন। এই ‘সৌজন্য বাস’ সার্ভিসের উদ্বোধন করেন তিনি গত ২২ জুন। এসব কাজে তাৎক্ষণিক বাহবা পাওয়া যায়, এমনকি নিজেকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার সুযোগও তৈরি হয়। কিন্তু নগরের যান চলাচলব্যবস্থা ও যাত্রীসাধারণের দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানের জন্য টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ না করে দুটি বাস দেওয়ার এই ‘বদান্যতা’কে দূরদৃষ্টির পরিচায়ক বলা যাবে না কিছুতেই। প্রায় ৬০ লাখ জনসংখ্যা-অধ্যুষিত ৬০ বর্গমাইলের এই নগরে কখন কোন পথ দিয়ে পুলিশ কমিশনার যাতায়াত করবেন এবং কখন কোনো অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনা চোখে পড়লে তিনি তার তাৎক্ষণিক সমাধান করবেন—এর জন্য অপেক্ষা করে থাকা নগরবাসীর কাম্য হতে পারে না।
পত্রপত্রিকায় এর আগেও নানাভাবে সংবাদ শিরোনাম হওয়ার সুযোগ হয়েছে আবদুল জলিল মণ্ডলের। সাত-আট মাস আগে কমিশনার হিসেবে নগর পুলিশের দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কিছু বিলবোর্ডে নগরবাসীকে নিজের ছবিসমেত ঈদ ও পূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। এর মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই অপসারিত হয়েছিল সেই ‘সচিত্র শুভেচ্ছাবাণী’।
এর কিছুদিন পরই ডিএমপি কমিশনার চট্টগ্রাম শহরের ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়ে সাফল্যও পেয়েছিলেন। রাস্তায় যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধ করে, রাস্তার দুই পাশা রাখা ইট-বালুর ব্যবসা বন্ধ করে একদিকে নগরের সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজ যেমন করেছিলেন, তেমনি নগরের যান চলাচলব্যবস্থায়ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। বিমানবন্দর ও শহরের মধ্যে যাতায়াতের সময় মাত্র ৩০-৪০ মিনিটে নেমে এল।
এ ছাড়া নগরের অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদের কাজে যখন সিটি করপোরেশন অসহায়, তখন পুলিশ কমিশনার এগিয়ে এলেন এ কাজে সহযোগিতা দিতে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দখলে থাকা এসব বিলবোর্ড উচ্ছেদের ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব তাঁকে রীতিমতো ‘অদম্য’ এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ঝাড়ু-কোদাল-বেলচা হাতে পরিচ্ছন্নতা অভিযানেও নেমেছেন ডিএমপি কমিশনার। তবে সে সময়ে ‘আপনারা এমন মেয়র নির্বাচন করুন, যাতে আমার ঝাড়ু হাতে নামতে না হয়’ মন্তব্যের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে প্রচারণার অভিযোগ ওঠে।
একটি শৃঙ্খলিত বাহিনীর কিছু নির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব থাকে। সেসব দায়িত্ব যথাযথ পালনের পর তারা যদি জনসেবায় অতিরিক্ত কোনো ভূমিকা পালন করতে চায়, সেটা নিশ্চয় প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু চট্টগ্রাম শহর সত্যিই সে রকম নিরাপদ ও নিরুপদ্রব শহরে পরিণত হয়েছে কম না, যাতে অন্য কাজে মনোযোগ দেওয়ার যথেষ্ট অবসর পুলিশের আছে, সেটা ভেবে দেখা দরকার সর্বাগ্রে।
নগরের অধিকাংশ মোড়ে পথনির্দেশিকা আলো জ্বলে না, জ্বললেও তার হলুদ, লাল বা সবুজ আলোর কোনো অর্থই যেন নেই চালকের কাছে। ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় যেটুকু সম্ভব যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে ইদানীং চলচ্চিত্রে নায়ক চরিত্রে প্রায়ই পুলিশ কর্মকর্তাদের দেখা যায়। এসব ছবির ব্যাপক ব্যবসায়িক সাফল্য থেকে আঁচ করা যায়, সাধারণ মানুষ পুলিশকে দেখতে চায় প্রকৃত নায়কের চেহারায়, তাঁরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনমনীয়, জীবন বাজি রেখে অসহায়-নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে দৃঢ়সংকল্প। কিন্তু সিনেমার সঙ্গে বাস্তবের যে দুস্তর ব্যবধান আছে, তা নগরবাসী বুঝতে শুরু করেছেন ধীরে ধীরে। চট্টগ্রাম শহরটা আবার ফিরে গেছে তার পুরোনো চেহারায়। এখন ফুটপাতগুলো আবার সেই হকারের দখলে। রাস্তার দুই পাশা গাড়ি পার্কিংয়ের পুরোনো অভ্যাসগুলোও ফিরে পেয়েছেন চালকেরা। এমনকি নির্মাণাধীন বাড়ির নির্মাণসামগ্রী রাস্তার পাশা রাখা বা ইট-বালুর ব্যবসাটাও চালু হয়েছে আগের নিয়মে। সত্যি কথা বলতে কম, শহরের যান চলাচলের বিশৃঙ্খলা ও যানজট স্মরণকালের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি। এই ব্যর্থতা কীভাবে এড়াবে সিএমপি?
গত ১৮ জুন শুলকবহর এলাকায় বেপরোয়া মিনি ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন সিটি কলেজের মেধাবী ছাত্র সত্যপ্রিয় দাশ (২৪)। এর মাত্র পাঁচ দিন আগে একইভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় আরও দুজন ছাত্রের প্রাণহানি ঘটেছে এই নগরে। এসব ট্র্যাজিক ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অনিয়ম ও অদক্ষতাকেই দেখিয়ে দেয়।
নগরের অধিকাংশ মোড়ে পথনির্দেশিকা আলো জ্বলে না, জ্বললেও তার হলুদ, লাল বা সবুজ আলোর কোনো অর্থই যেন নেই চালকের কাছে। ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় যেটুকু সম্ভব যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এদিকে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়েও বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা পেয়ে কিছুদিন এসব রিকশা পথে নামে, আবার নির্দিষ্ট সময়ান্তে পুলিশ এই রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়। প্রায় ৭০ হাজার রিকশা কিছুদিন চলাচল করে, আবার একদিন সকালে হঠাৎ করে এই বিরাটসংখ্যক রিকশা রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়। একদিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকেরা ইচ্ছামতো দাম হাঁকান ও অন্যদিকে পর্যাপ্ত গণপরিবহনের অভাবে মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষেরা চরম দুর্ভোগের শিকার হন। অর্থাৎ পুলিশের এসব তৎপরতার মধ্যে সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে না।
নগর আবর্জনামুক্ত রাখার উদ্যোগ, বিলবোর্ড উচ্ছেদ করে সিএমপি কমিশনার নিজের ও পুলিশ বাহিনীর যে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের কেন্দ্র দখলসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারায় তা নিষ্প্রভ হয়েছে। নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাম্প্রতিক এক মাসের পরিসংখ্যান হাতে নিলেও তাঁর ব্যর্থতার পাল্লাটাই ভারী হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালের মে মাসে নগরে খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল যথাক্রমে ১০টি ও ১টি, ২০১৫ সালের মে মাসে এই সংখ্যা যথাক্রমে ১৫ ও ৯টি।
গত ১০ জানুয়ারি নার্সিং কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অঞ্জলি রানী দেবীকে তাঁর বাসভবনের সামনের গলিতে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। অপরাধীদের গ্রেপ্তার দূরে থাক, এ ঘটনার কোনো সূত্রই বের করতে পারেনি পুলিশ। আসল কথা, নাটক-সিনেমার পুলিশের পক্ষে জনমনোরঞ্জনের জন্য অসাধ্যসাধন করা যত সহজ, বাস্তবের পুলিশের পক্ষে বিষয়টা তত সহজ নয়। পুলিশ যদি তার নিয়মিত দায়িত্বের পরিধি ছাড়িয়ে জনকল্যাণের কাজে এগিয়ে আসে, তাতে আপত্তির কিছু নেই, কিন্তু নগরবাসী চাইবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু সুষ্ঠুভাবে পালন করবে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.