পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০: প্রয়োগ ও কার্যকারিতা

৯ জুলাই ২০১৫, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০: প্রয়োগ ও কার্যকারিতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: আমাদের আজকের বিষয় পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০-এর প্রয়োগ ও কার্যকারিতা। আমরা এ বিষয়ে কত দূর অগ্রসর হতে পেরেছি, আমাদের সমস্যা কোথায়, এই আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে আমরা আর কী কী করতে পারি—এসব বিষয়েই আমরা আজ আলোচনা করব।
একটা সময়ব্যাপী অনেক নারী সংগঠন, বেসরকারি সংগঠন এ নিয়ে আন্দোলন করেছে। শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালে এই আইনটি হয়। তারপরও অনেক দিন আইনটি সুপ্ত অবস্থায় ছিল, সংশ্লিষ্ট বিধি প্রণয়ন করতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেছে।
 ২০১১ সালে বিবিএস অর্থাৎ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, দেশের ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী কোনো না কোনোভাবে পরিবারে স্বামী বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, আর ৮০ শতাংশ নারী মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব বিষয় আজকের আলোচনায় আসবে। এখন আলোচন করবেন আবুল হোসেন।
আবুল হোসেন
আবুল হোসেন
ভারতে ২০০৫ সালে এ রকম একটা আইন প্রণীত হয়। এরপর আমাদের দেশেও এমন একটি আইন প্রণয়নের ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি আসতে থাকে। তখন এ লক্ষ্যে একটি জোটও গঠন হয়, পারিবারিক সহিংসতা রোধে নাগরিক জোট। এরপর সেই জোট আর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা এই আইনের খসড়া প্রণয়ন করি। বর্তমান মাননীয় স্পিকার তখন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। সে সময় তিনি এই আইন প্রণয়নকেই তাঁর অগ্রাধিকার হিসেবে ঠিক করেন। এরপর সব প্রক্রিয়া শেষ হলে ২০১০ সালে সংসদে আইনটি পাস হয়।
তবে আইনটির বিধি প্রণয়ন করতে আরও তিন বছর লেগে যায়। তিনটি সংস্থা মূলত এই আইনটি নিয়ে কাজ করে। প্রথমত, উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা আইনটির প্রয়োগকারী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তারা কাজ করেন, তৃতীয়ত, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও (এনজিও) এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কোন এনজিওগুলো কাজ করবে, আমরা তাদের তালিকা গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করেছি। আর বিধিতে যে রেজিস্ট্রারের কথা বলা হয়েছে, সেটা আমরা করে ফেলেছি। আমরা আবেদন ফরম ছাপিয়েছি, যেখানে অভিযোগকারীর কথা লিপিবদ্ধ করা হবে। আমরা এই ফরমটি প্যাড আকারে ছাপিয়ে ৬৪টি জেলার প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।
পাশাপাশি আমরা প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তথ্য সংরক্ষণের রেজিস্ট্রার দেশের সব থানায় পাঠিয়ে দিয়েছি। ফলে এখন কেউ চাইলে মামলা করতে পারবেন, আগে যে জটিলতা ছিল, সেটা আর এখন নেই। পিএইচআর ও বিএনডব্লিউএলকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ, তারা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের এই আইন ও তার প্রয়োগের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
একই সঙ্গে তারা সংশ্লিষ্টদের জন্য পরিচিতিমূলক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছে। আমার কথা হচ্ছে সরকার আইন করেছে। এখন বড় এনজিওগুলো দায়িত্ব নিলে মানুষ আইনটি সম্পর্কে জানতে পারবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো একসঙ্গে বসে আইনের দুর্বলতা খুঁজে বের করতে পারে। 
ফারহানা আফরোজ
ফারহানা আফরোজ
শুরুতে প্রটেক্টিং হিউম্যান রাইটস প্রকল্প সম্পর্কে ধারণা দেওয়া দরকার। এটি একটি পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প। এর লক্ষ্য হচ্ছে কর্ম এলাকায় পারিবারিক সহিংসতার উচ্চহার কমিয়ে আনা। এটি বাংলাদেশের ছয়টি জেলার আটটি উপজেলার ১০২টি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১০ সালের আগে পারিবারিক সহিংসতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো না। আমাদের লক্ষ্য ছিল, আইনটি বাস্তবায়নে কাজ করা। এর সঙ্গে যঁারা সংশ্লিষ্ট আছেন, তঁাদের দক্ষতা বাড়ানো ও আইনটি বাস্তবায়নে তঁাদের সংবেদনশীল করে তোলা।
আমরা যখন কাজ শুরু করি, তখন কর্ম এলাকার নারীরা অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে তেমন একটা আসতেন না। প্রথম বছর ইউনিয়ন পর্যায়ে মাত্র ২৫৬ জন নারী অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন, আর আজ চার বছর পর সেই সংখ্যা ৫৪ গুণ বেড়েছে, সাড়ে ১৩ হাজার নারী আমাদের কাছে তঁাদের অভিযোগ জানিয়েছেন।
আমরা তঁাদের আইনি সহায়তা প্রদান করেছি। যেসব নারী সন্তানসহ পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, আমরা তঁাদের সুরক্ষাসহ ভরণপোষণ লাভ করতে সহায়তা করেছি। তালাকের পর নারীরা তঁাদের মালামাল নিয়ে যেতে পারতেন না, আমরা এখন তঁাদের সেই মালামাল উদ্ধার করতে সহায়তা করছি।
এই আইন সে ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পেরেছে। পাশাপাশি এই আইনে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে বিচারকদের অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
তৌহিদা খন্দকার
তৌহিদা খন্দকার
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০-এর প্রয়োগ ও কার্যকারিতা নিয়ে আমি একটি উপস্থাপনা পেশ করছি। এই আইনটি হওয়ার আগে সাধারণ আইনজীবীরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এই মামলাগুলো করতেন। এতে পরিবারে আরও বেশি সমস্যা সৃষ্টি হতো। কারণ, ওই আইনে মামলা হলে ৬০ দিনের মধ্যে জামিন পাওয়ার সুযোগ ছিল না।
আর দেখা যেত, পরিবারের প্রায় সবাইকে, এমনকি যারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না, তাদেরও আসামি করা হতো। ফলে নানা সমস্যা হতো। এ কারণে নারী আইনজীবীদের প্রত্যাশা ছিল, সংসার ধরে রাখতে পারে এমন একটি আইন করা হবে। এই আইনটির মাধ্যমে সে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।
পিএইচআর প্রকল্প শুরু হওয়ার এক বছর আগে একটি জরিপ করা হয়েছিল। সেই জরিপে দেখা যায়, ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। সেই জরিপে আরও দেখা যায়, ৩৮ শতাংশ নারী মনে করেন, স্ত্রীকে নির্যাতন করার অধিকার স্বামীর আছে। এমনকি এখনো যে কর্ম এলাকায় আমরা কাজ করি, সেখানকার নারীরা বলেন, স্ত্রীকে ছোটখাটো চড়-থাপড় মারা, সকালে উঠে গালাগাল করার অধিকার স্বামীর আছে।
ফলে এই আইনের বাস্তবায়ন কত দূর হয়েছে, আমরা তা এখান থেকে বুঝতে পারি। প্রথমত, আমরা পারিবারিক সহিংসতা যে অপরাধ, আর এ–সংক্রান্ত যে একটি আইন আছে, সে বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি। ইউনিয়ন পর্যায়ে সুরক্ষা দল তৈরি করা হয়েছে, আর তারা কীভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে, সে বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিচারব্যবস্থাকে প্রতিটি ইউনিয়নে মানুষের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেওয়ার জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
আইন যঁারা বাস্তবায়ন করবেন, তঁাদের দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো আইনে মানসিক নির্যাতনের বিচার করার সুযোগ নেই, এই আইনে সেটা করা সম্ভব হয়েছে।
আর আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগও এ অাইনে আছে। এই আইনে আমরা পারিবারিক সহিংসতার সংজ্ঞা পেয়েছি। এই আইনে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা সত্ত্বেও স্ত্রীকে স্বামীর ঘরে বসবাসের আদেশ দিতে পারেন আদালত, এটা খুবই ইতিবাচক একটা ব্যাপার।
 সালিসের ক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষা নেই, আদালত এই আদেশও দিতে পারেন। মামলা চলাকালীন তঁাকে কেউ হয়রানি বা নির্যাতন করতে পারবে না। আবার শেল্টার সাপোর্টের  বিধান আছে এই আইনে। বিচারক যদি মনে করেন, অভিযোগকারী স্বামীর ঘরে নিরাপদ নন, তাহলে নিরাপত্তার জন্য তঁাকে শেল্টার সাপোর্টে রাখার আদেশ দিতে পারেন।
 এমনকি সন্তানের সুরক্ষার বিধানও এই আইনে আছে। অনেকগুলো ভালো দিক থাকা সত্ত্বেও আইনটির প্রয়োগ হচ্ছে না। পিএইচআরের অ​াটটি উপজেলায় তিন বছরে মামলা হয়েছে ১৭১টি আর একই জেলার অন্য ৫৭টি উপজেলায় মামলা হ​ে​য়ছে ৮১টি।
নারীরা স্বামী ও তঁার আত্মীয়দের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে চান না। ফলে অনেক অভিযোগই দেরিতে আসে, আর সেটা এই আইনের আওতায় আনা যায় না, তখন সেটা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় আনতে হয়। কিছু ঘটলে দেখা যায়, নারীরা তাৎক্ষণিকভাবে স্বামীকে শাস্তি দিতে চান। সেটা এই আইনে সম্ভব নয়। আবার অনেক সময় আদালতের পরিবেশ এই আইনের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
৬০ শতাংশ মামলার ক্ষেত্রে মানুষ দ্রুত সালিসের মাধ্যমে বিচার চায়। কিন্তু এই আইনে সুস্পষ্টভাবে সালিসের কথা নেই। আর মালামাল উদ্ধারের বিষয়ে এখানে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই, কে উদ্ধার করবে, কীভাবে নিয়ে যাবে সে বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। কিছু সুপারিশ পেশ করছি: আইনের ধরন বিবেচনা করে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের পরিবর্তে দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে পারিবারিক আদালতকে দেওয়া যেতে পারে।
আর তদন্তের সময়সীমা ১০-১৫ দিন নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত, বিধিমালা আরও বিস্তারিত হওয়া উচিত। আর সংবাদমাধ্যমকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে, আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। চলমান মামলা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রাখা উচিত।
গৌরাঙ্গ চন্দ্র মণ্ডল
গৌরাঙ্গ চন্দ্র মণ্ডল
দুই বছরে ২৫টি মামলার তদন্ত করেছি। এর মধ্যে ১৭টি মামলার তদন্ত শেষে মালামাল বিবাদীকে  বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। মামলায় তদন্তের সময়সীমা নির্ধারিত থাকে, কিন্তু আমাদের কাছে চিঠি আসে থানা হয়ে। ফলে নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর চিঠি আমাদের হাতে আসে। সে ক্ষেত্রে তদন্ত করতে একটু সময় লেগে যায়।
এ ছাড়া বিবাদীদের নোটিশ দেওয়া হয় না। আর মালামাল উদ্ধার করে বিবাদীকে চিঠির কপি দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আদেশ নেই, তারপর সোনাদানার ক্ষেত্রে আমরা ঝামেলায় পড়ি, কারণ এটা দৃশ্যমান নয়। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চান না। ফলে মালামাল উদ্ধার করতে সমস্যা হয়।
বিবাদীরা নানা চাতুরীরও আশ্রয় নেয়। আবার বিবাদীরা থানাকে প্রভাবিত করে চিঠি প্রেরণে বিলম্ব সৃষ্টি করে। আদালত চিঠি দেন না বলে বিবাদীরা স্বাক্ষর করতে চায় না। এ ছাড়া আরও নানা বাস্তব সমস্যার সৃষ্টি হয়। মালামাল জব্দ করে কোথায় রাখা হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই।
মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে অত জায়গা নেই, আবার থানা বলে তাদের তো মালামাল রাখার কথা নয়। অনেক মামলায় দেখা যায়, স্বামী বিদেশে থাকে। পারিবারিক সহিংসতার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ রোধেও কাজ করছি।
জিনাত আরা হক
জিনাত আরা হক
আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে কাজটা স্রেফ প্রকল্পের মধ্যে যেন সীমিত না থাকে। কারণ, প্রকল্পের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়। আমাদের বর্তমান স্পিকার এই আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আইন মানেই কি শাস্তি দেওয়া? মানুষ মনে করত, নির্যাতন হয় ঘরের বাইরে। এ রকম একটা ভ্রান্ত ভাবনা আমাদের ছিল। কিন্তু আমরা বলেছি, পরিবারেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন হয়।
বিবিএসের জরিপের আগে আইসিডিডিআরবির একটি জরিপ ছিল। যেখানে ৬০ ভাগ নারী বলেছিলেন, তঁারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। কথা হচ্ছে এই আইনটি আমরা ধারণ করতে পারছি কি না। এই আইনটি প্রতিরোধমূলক। কিন্তু দেখা যায়, নারীরা এই আইনের দ্বারস্থ হলে স্বামীরা স্ত্রীকে তালাক দেয়।
এই আইনটি আসলে চরিত্র সংশোধনমূলক, যেটা পাশ্চাত্যে আছে। কিন্তু আমাদের দেশে সে রকম বিধান নেই বললেই চলে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এই ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের মানদণ্ড নেই, এটা এই আইনের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ। শুধু মালামাল উদ্ধার নয়, কেউ সহিংসতায় আহত হলে তার ক্ষতিপূরণ তো দিতে হবে, সেটা নির্ধারণের একটি মানদণ্ড থাকতে হবে।
এই আইনের অনেক ভালো দিক আছে, সেগুলো ঠিকঠাক প্রয়োগ হচ্ছে না। এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অংশীজনের সংখ্যা অনেক, অনেকগুলো সংস্থা একত্রে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছি, সেখানে একটি পৃথক আদালত সেটি পরিচালনা করছেন। কারণ, এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন মানসিকতা থাকতে হবে। এখানে একজন নারী তঁার স্বামী, শ্বশুরের বিচার চাচ্ছেন, আবার তিনি ঘরও ভাঙতে চাচ্ছেন না। আমাদের সমাজে সেটা করা খুব কঠিন। ফলে এটা নিছক ফৌজদারি মামলার মতো চোর-পুলিশের ব্যাপার নয়।
বেসরকারি সংস্থাগুলো সাধারণত আলাদাভাবে কাজ করে, এটা আমার এক দুঃখের জায়গা ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারছি। গণমাধ্যমও এ বিষয়টিতে জোর দেবে আশা করি।
হোমায়রা আজিজ
হোমায়রা আজিজ
নারী নির্যাতনের রূপ হিসেবে আমরা শারীরিক নির্যাতন ও যৌতুক—এ দুটোকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। কিন্তু পরিবারের মধ্যে যৌন নির্যাতন যে পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে পড়ে, সে বিষয়ে আমরা এখনো সচেতন নই। ফলে এটা যে প্রতিকারমূলক আইন, তার সুবিধা তারা নিতে পারছে না।
এমনকি মানসিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনও যে পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে পড়ে, সেটা সবাইকে বুঝতে হবে। ফলে শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নয়, স্থানীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম ও আইনজীবী তঁাদেরও এটা বুঝতে হবে। দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে এই আইনে নারীরা কোন ধরনের প্রতিকার পাবেন, সেটাও নারীদের জানাতে হবে।
প্রান্তিক নারীদের কাছে এই তথ্য পৌঁছানোর ভালো ব্যবস্থা নেই। সরকার ও কিছু এনজিও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে, কিন্তু শুধু এটুকুই যথেষ্ট নয়। সমাজের সবাইকে এ নিয়ে কাজ করতে হবে। তৃতীয়ত, পারিবারিক সহিংসতা নারীসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আমরা মনে করি, এ ধরনের আইন শুধু আইনিভাবে কার্যকর করা সম্ভব নয়, এর জন্য সমাজের অংশগ্রহণ দরকার। অর্থাৎ সমাজে মানুষের সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আবার এর কারণে শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তার মানসিক বিকাশ হচ্ছে না, পুষ্টি চাহিদা মিটছে না, শিক্ষা গ্রহণ ভালো হচ্ছে না, মায়েরা আমাদের কাছে এমন অভিযোগ করেছেন।
এই সামগ্রিক সামাজিক ক্ষতির দিকটা বুঝতে না পারলে আমরা এই আইনের সুফল পাব না। আর আইনের আশ্রয় নিতে গেলে তো নারীদের নানা কলঙ্কের ভাগীদার হতে হয়। ফলে যে পুরুষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, তাদের জন্য  পরামর্শ সহায়তার ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
আর ভরণপোষণের ক্ষেত্রে দেখেছি, আদালত দ্বারা নিশ্চিত করা না গেলে সেটা বাস্তবায়ন করা যায় না। সে কারণে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। গ্রামে-গঞ্জে কাজ করে মনে হয়েছে, আদালতে সাধারণ মানুষের যাতায়াত আরও বাড়াতে হবে, তার পরিবেশ আরও বন্ধুত্বপূর্ণ করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট আদালতের প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়েও ভাবার অবকাশ আছে। আর নারী অধিকার–সংক্রান্ত অন্যান্য আইনের সঙ্গে এটিকে কীভাবে সংগতিপূর্ণ করা যায়, তা-ও আমাদের ভেবে দেখতে হবে, আইন প্রণয়নের সময়ও আমরা এ কথা বলেছি।
তালাকের ক্ষেত্রে তো স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির মালিকানার অধিকার পান, এ বিষয়ে কিছু করা যায় কি না তা ভেবে দেখতে হবে। যদি তালাকের পরিমাণ বাড়তে থাকে, তাহলে এই আইনের অধীনে মামলা চলাকালে তালাক দেওয়া যাবে না, এমন বিধান করা যায়।
 শেষ কথা হলো ক্ষতিপূরণের জন্য প্রশাসনিক নীতিমালা ও হাতিয়ার তৈরি করা দরকার, তাহলে নারীরা এই আইনের দ্বারস্থ হতে উৎসাহী হবেন। সামগ্রিকভাবে এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকারের সীমিত অংশগ্রহণ থাকতে পারে, সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। 
সাব্বির মাহমুদ চৌধুরী
সাব্বির মাহমুদ চৌধুরী
এই আইনে ধারা ৪(ঘ), ৬(ঙ)​েত লিগ্যাল এইডের সাহায্য নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আমি বলব, এই আইনের সঙ্গে লিগ্যাল এইডের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। নারীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে লিগ্যাল এইড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমরা আইনি তথ্য সরবরাহ করি। মামলার খরচ নির্বাহ করি, সালিসের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করি, সেটা মামলার আগেও হতে পারে, আবার পরেও হতে পারে। একজন নারী পরামর্শের জন্য আমাদের কাছে আসতে পারেন।
তিনি মামলা না করে অপর পক্ষের সঙ্গে সালিস করতে চাইলেও আমাদের মাধ্যমে তা করতে পারেন। এমনকি মামলা করার পরও তঁারা আসতে পারেন। এই আইনটি আমাদের দেশের একটি অনন্য আইন। এই আইনে শাস্তির বদলে প্রতিকারের কথা বলা হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এই আইনে তত্ত্বাবধানের অভাব রয়েছে, সমন্বয় ও যোগাযোগ করা হচ্ছে কি না, তা আমরা জানি না। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন আইনজীবীরা।
যঁার সামর্থ্য আছে, তিনি তো আর এনজিওগুলোর কাছে যাবেন না, তঁাকে আমরা সহায়তাও দেব না। এই মানুষেরা আইনজীবীদের কাছে গেলে তঁারাই সিদ্ধান্ত নেন, কোন মামলা করা হবে। আবার এই আইনে শিশুদের ব্যাপারে বিস্তারিত বলা হয়নি। আলাদা আদালতের কথা এসেছে। আমার মনে হয়, পারিবারিক আদালতের বিষয়টি চিন্তা করা উচিত ছিল।
কিন্তু পারিবারিক আদালতের আংশিক ফৌজদারি চরিত্র আছে। এই মামলাগুলো ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেও যায়, ফলে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তৈরি হয়। মামলার ধারা কী, প্রকৃতি কী—সেগুলো আর বিবেচ্য বিষয় থাকে না। ফলে এই ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতই ভালো।
তদন্তের বিষয়ে যে মতামত এসেছে, আমাদের সে ব্যাপারে দ্বিমত আছে। কারণ, আপসের সম্ভাবনা থাকলে হঠাৎ করে আদেশ দিয়ে দিলে তো শেষ, আর কিছু থাকল না।
সে কারণেই মামলাটা আমাদের সময় সময় একটু দীর্ঘায়িত করতে হয়। আদালতের আদেশের কপির কথা এসেছে। কথা হচ্ছে, আদালত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব বলে দিলে সমস্যা হতে পারে। অনেক সিদ্ধান্ত ঘটনাস্থলে না গেলে নেওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আপনাকে নিজের বিচক্ষণতা কাজে লাগাতে হবে।
সৈয়দা শিরীন আকতার
সৈয়দা শিরীন আকতার
এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির মাধ্যমে সিলেটে ৮০ জন আইনজীবীকে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এমনকি আমরা বিজ্ঞ বিচারক মহোদয়ের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছি। তবে এটাও যথেষ্ট নয়। এই প্রকল্পের প্যানেল আইনজীবী হিসেবে আমি সিলেটে ২৮টি মামলা পরিচালনা করেছি।
৬০ ভাগ ক্ষেত্রে সালিসের মাধ্যমে সমস্যার সমধান হয়ে গেছে। কিছু তালাক হয়েছে, আর বেশির ভাগ নারীই নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ভুক্তভোগী নারীরা অনেক দেরি করে আসেন, তঁারা আসেন পরিস্থিতি তালাকের পর্যায়ে চলে গেলে।
অনেক ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট জারি হলে প্রতিপক্ষ এসে বলে, তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, সেখানে তঁার সন্তান হয়েছে। ফলে সে আর এই স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে এই আইনে প্রতিকার দেওয়া সম্ভব নয়।
তখন দেনমোহর ও ভরণপোষণ আদায়ের জন্য পারিবারিক আদালতে যেতে হচ্ছে। অন্যদিকে ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনজীবীদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, তঁারা অনেক সময় এসব মামলা গতানুগতিকভাবে পরিচালনা করেন। শাস্তি বা খালাস—এর মধ্যেই তঁারা সীমাবদ্ধ থাকতে চান। প্রতিকার বা সুরক্ষার দিকে তঁাদের নজর নেই।
এই আইনে ভরণপোষণের কথা বলা আছে, কিন্তু না জানার কারণে সেটা অনেক সময় প্রয়োগ করা হয় না। এই আইনের প্রয়োগের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট, আইনজীবী, পুলিশ, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা—সবারই সমন্বিত প্রশিক্ষণ দরকার। বিচ্ছিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে লাভ নেই।
এই মামলার জন্য জেলা পর্যায়ে আলাদা আদালত থাকা দরকার। তা না হলে মামলা দীর্ঘায়িত হয়। আলাদা আদালত থাকলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) প্রক্রিয়ায় এসব মামলা আরও ভালোভাবে চালানো সম্ভব হতো।
এই আইনে এ রকম একটি বিধান যুক্ত করা যেতে পারে যে ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিটি মামলায় একটি বা দুটি সেশন এডিআর করতে বাধ্য। গত চার বছরে বালাগঞ্জ উপজেলা থেকে আমরা এডিআরের মাধ্যমে ভরণপোষাণ ও দেনমোহরের ১ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আদায় করতে পেরেছি, আদালতের মাধ্যমে সেটা হয়তো সম্ভব হতো না বা দীর্ঘায়িত হতো।
 প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে তো মানুষকে লিগ্যাল এইডের কাছে যেতে হবে। কিন্তু মানুষ বিনা মূল্যে আইন সহায়তার বিষয়টি মানুষ জানে না। ফলে এ–বিষয়ক প্রচার–প্রচারণা চালাতে হবে। এই সেবাটিকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে।
শাহনাজ হুদা
শাহনাজ হুদা
সত্যি কথা বলতে, এখন পর্যন্ত স্নাতক পর্যায়ে এই আইনে তেমন জোর দেওয়া হয়নি। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তুলনামূলক পারিবারিক আইনের ওপর একটি অধ্যায় আছে। সেখানে পারিবারিক সহিংসতা ও লৈঙ্গিক সহিংসতার বিষয়ে পড়ানো হয়। আমাদের গ্রাম আদালতকে অনেকে আদালত বলতে চান না।
কারণ, এটি পুরোপুরি বিচারিক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি আংশিক বিচারিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে বিচারক থাকেন না, ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচজন সদস্য এখানে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। গ্রাম আদালতের আইনে একটি বিধান যুক্ত করা হয়েছে, কোনো নারীর মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে সেখানে একজন নারী থাকতেই হবে। জেলা আদালত অনেক দূর, নারীরা আবার সেখানে নানা কারণে যেতে চান না। ফলে গ্রাম আদালতে কিছু কাজ হয়ে গেলে ভালো হয়। পারিবারিক আদালতের বিচারককে যেন অন্য মামলা পরিচালনা করতে না হয়। এটা বোধ হয় শুধু ঢাকাতেই আছে, অন্য জায়গায় নেই।
এই আইনে সহিংসতার শাস্তির বিধান নেই। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শুধু যৌতুকের বিচার হয়। কিন্তু যদি এমন হয়, তখন স্বামী স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে বা তার অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে, আর তা নিয়ে সহিংসতা হয়, তাহলে সেই নারীর প্রতিকার চাওয়ার জায়গা থাকে না।
সে কারণে তঁাকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়, বলতে হয়, স্বামী যৌতুক চেয়েছিল, দেওয়া হয়নি বলে সে স্ত্রীকে মেরেছে। এমনও হয়েছে, আদালত এ ধরনের মামলা তঁার এখতিয়ারভুক্ত নয় বলে সেশন আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এ জন্য সহিংসতার বিচার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নিয়ে আসা উচিত। আর স্বামীর স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি সেটা আদালতের মাধ্যমে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে একটা সংযোগ সৃষ্টি করা যাবে।
সালমা আলী
সালমা আলী
এই আইনের প্রতিটি লাইন নিয়ে অনেক চিন্তা করা হয়েছে। কিন্তু আইনটি বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আমরা বলেছিলাম, পারিবারিক আদালতে এই আইনটি প্রয়োগ করা হোক।
তারপর আমরা গ্রাম আদালতের কথা বলেছিলাম, এই প্রতিষ্ঠানটিকে আরও উন্নত ও কার্যকর করা যায় কি না। আইনটির উন্নয়ন ঘটানোর এখনো সময় আছে। মুসলিম দেশগুলোতে তালাকের সময় সব মিটিয়ে ফেলা হয়, দেনমোহর, ভরণপোষণ প্রভৃতি। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না। সারা পৃথিবীতেই নারীবান্ধব ভালো আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই।
আমরা এটা প্রমাণ করতে পেরেছি, পারিবারিক নির্যাতন আর শুধু ঘরের ব্যাপার নয়, এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মেয়েরা সংসার টিকিয়ে রাখতে চায় বলে তারা এটা ঘরের বাইরে আনতে চায় না
এদিকে আইনের বিধিতে কিছু পরিবর্তন আনা দরকার। বিশেষ করে মামলাটা দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। কারণ, একটি মেয়ে অনেক ধাপ পেরিয়ে মামলা করতে আসে। ফলে সে যেন আইনজীবী ছাড়াই মামলা করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে, বিধিতে এটা আনা দরকার।
বিচারক নাইমা হায়দারের আদালতে এমন দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি, সেখানে ই-মেইলের ভিত্তিতে মামলা নেওয়া হয়েছে। এই আইন প্রয়োগ, নারীর সুরক্ষা, প্রতিকার প্রভৃতি সবকিছুর জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ লাগবে। সর্বোপরি, আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিহার করতে হবে। আইন বাস্তবায়নে সমন্বয় ও মনিটরিং প্রয়োজন হবে। দেখা যায়, যেখানে প্রকল্প আছে, সেখানে ভালো কাজ হয়, ভারতেও সেটা হয়েছে।
মালিক আব্দুল্লাহ্‌ আল-আমিন
মালিক আব্দুল্লাহ্‌ আল-আমিন
আমাদের সুন্দর একটি আইন আছে। এই আইনকে আরও বেশি কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তা না হলে আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছাতে সময় লাগবে। এটি একটি ফলপ্রসূ আইন। আমরা এই আইনটিকে অরও বেশি কার্যকর করতে চাই। এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত হলে ভুক্তভোগীরা বিশেষভ​​াবে উপকৃত হবে। তবে বাস্তবতা হলো আমরা এখনো সবার দোরগোড়ায় যেতে পারিনি। এ ​ি্বষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।  কিন্তু প্রকল্প এলাকায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। প্রকল্প এলাকার মতো সারা দেশে এ অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন।
সরকার এ ক্ষেত্রে সচেতন রয়েছে। সরকার এ​​ ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকাও র​াখছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনা মূল্যে দরিদ্রদের আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। তবে সবাইকে সচেতন করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: অামরা পারিবারিক সহিংসতামুক্ত সমাজ দেখতে চাই। এ​ ক্ষে​েত্র সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। পারিবারিক সহিংসতার বিচারের উদ্দেশ্য হলো সম্ভব হলে পরিবারের মধ্যে রেখেই সমাধান বের করা। এ দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা প্রয়োজন। প্রথম আলোর পক্ষ​ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।  
পারিবারিক সহিংসতা একটি অপরাধ। এর প্রতিকারের জন্য আইন রয়েছে। ইউএসএআইডির অর্থায়নে প্রটে​ক্টিং হিউম্যান রাইটস (পিএইচআর) পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প। এ প্রকল্পে কাজ শুরুর সময় ইউনিয়ন পর্যায়ে মাত্র ২৫৬ জন নারী অভিযোগ করেন। আজ চার বছর পর এ সংখ্যা ৫৪ গুণ বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৩ হাজার
* ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ​শিকার হন
* ৮৭ শতাংশ নারী জীবনে একবার হলেও স্বামীর দ্বারা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন
  সূত্র: পিএইচআর ভিত্তি জরিপ ২০১১ এবং বিবিএস জরিপ ২০১১ 
আলোচনায় সুপারিশ
* এই আইনের অধীনে মামলা পরিচালনার ক্ষে​েত্র আইনি সহায়তা প্রদান সংস্থার ভূমিকা আরও বেগবান করা
* মানুষ বিনা মূল্যে আইন সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি জানে না। এ বিষয়ে প্রচার–প্রচারণা চালাতে হবে। এই সেবাটিকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে
* মামলা চলার স​ময়ে তালাক দিতে হলে তা আদালতের মাধ্যমে করতে হবে‍—আইনে এমন বিধান অন্তর্ভুক্তকরণ 
* সকল পর্যয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করতে হবে
* মহিলা–বিষয়ক কর্মকর্তার দক্ষতা উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন, লজিস্টিক সাপোর্ট ও বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন 
যাঁরা অংশ নিলেন
মালিক আব্দুল্লাহ্‌ আল-আমিন: পরিচালক (জেলা জজ), জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা
শাহনাজ হুদা                 :  সাবেক চেয়ারপারসন, আইন অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আবুল হোসেন               :  প্রকল্প পরিচালক, নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্প
সালমা আলী                  :  নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
সাব্বির মাহমুদ চৌধুরী              :  জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ), জেলা ও দায়রা জজ অফিস ঢাকা      
সৈয়দা শিরীন আকতার  :  প্যানেল আইনজীবী, পিএইচআর প্রোগ্রাম, সিলেট
হোমায়রা আজিজ          :  পরিচালক, নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়ন, কেয়ার বাংলাদেশ
জিনাত আরা হক           :  ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর, আমরাই পারি, পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট
গৌরাঙ্গ চন্দ্র মণ্ডল          :  উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা, বালাগঞ্জ সিলেট
তৌহিদা খন্দকার           :  পরিচালক, আইন সহায়তা, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি
ফারহানা আফরোজ       :  প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপক, পিএইচআর প্রোগ্রাম, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ  
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম           : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.