রাজধানীতে বাড়তি ৩০০ চিকিৎসক তবু চলছে পদায়ন by শেখ সাবিহা আলম

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ঢাকার বাইরে পাঠাতে চাইছেন। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, চিকিৎসকদের জন্য বদলির নীতিমালা হচ্ছে। কিন্তু, ঢাকায় সংযুক্তির নামে তিন শতাধিক বাড়তি চিকিৎসক থাকার পরও এ মাসের প্রথম ১৫ দিনে কমপক্ষে সাতজনকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে। ঢাকায় এসব বাড়তি সংযুক্তি ও পদায়নের অন্যতম কারণ রাজনীতি—বলছে একটি আন্তর্জাতিক চিকিৎসা গবেষণাপ্রতিষ্ঠান।
৮ জুলাই কুমিল্লার মেঘনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে দুজনকে ঢাকার ৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে। সচিবালয় ক্লিনিকে সংযুক্তিতে থাকা চর্ম ও যৌন রোগের পরামর্শককে পদায়ন করা হয়েছে সচিবালয় ক্লিনিকেরই জ্যেষ্ঠ পরামর্শক হিসেবে। এ ছাড়া রক্তসঞ্চালন, প্রাণরসায়ন, নাক, কান, গলা ও মেডিসিন বিভাগে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে সংযুক্তিতে থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়মিত পদে পদায়ন করা হয়েছে। জুলাইয়ের প্রথম ১৫ দিনে ঢাকা থেকে বাইরে বদলি হয়েছেন মাত্র একজন—সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকার সরকারি ১০টি হাসপাতাল ও চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে সংযুক্ত বাড়তি চিকিৎসকের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞ এসব চিকিৎসক নিজ বিষয়ের বিভাগে সংযুক্তি পাচ্ছেন। আবার কেউ সংযুক্তি পাচ্ছেন অন্য বিভাগেও।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া নথিতে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সংযুক্তিতে থাকা কমপক্ষে ২৫ জন চিকিৎসক সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁরা এক যুগের বেশি সময় ধরে ঢাকায় আছেন। অথচ নতুন মেডিকেল কলেজ ও জেলা-উপজেলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠানোর কথা বলে আসছেন।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সব হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে। বদলির একটি নীতিমালা করা হচ্ছে। নীতিমালায় চার বছর পরপর চিকিৎসকদের বদলির বিধান রাখা হচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ে চিকিৎসকদের বদলি-পদায়নের সঙ্গে যুক্ত কমপক্ষে তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসকদের ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় পাঠানোর বিষয়টি এখনো চিন্তাভাবনার পর্যায়ে রয়েছে। এটা নিয়ে খুব দৌড়ঝাঁপ আছে, সে কথা বলা যাবে না।
চিকিৎসকদের সংযুক্তি বা বদলির বিষয়টি দেখভাল করে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর। সংযুক্তিতে থাকা চিকিৎসকেরা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে প্রথম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগ দেন। পরে অধিদপ্তর থেকে তাঁদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়।
অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি চাকরিতে তিন বছর পরপর বদলির একটি প্রথা থাকলেও চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। সংযুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘জনস্বার্থ’ বিবেচনা করা হয়। তবে জনস্বার্থ বলতে আসলে কী বোঝায়, তার কোনো ব্যাখ্যা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলতে পারেননি।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) এহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকায় সংযুক্তিতে থাকা চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি। আমরা চাই ঢাকার বাইরে চিকিৎসকেরা সংযুক্তি নিয়ে যাক। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।’
তথ্য অধিকার আইনে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাওয়া কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত ৩০০ চিকিৎসকের মধ্যে কয়েকটি নির্দিষ্ট বিভাগের বিশেষজ্ঞদের ঢাকায় সংযুক্তির সংখ্যা বেশি। এই বিভাগগুলো হলো স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা, হৃদ্রোগ, অর্থোপেডিক সার্জারি, রেসপিরেটরি মেডিসিন, নিউরোসার্জারি ও শিশু। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগে পদের অতিরিক্ত ৩২ জন, হৃদ্রোগে ৩০ জন, অর্থোপেডিক সার্জারিতে ২৩ জন, রেসপিরেটরি মেডিসিনে ১৭ জন, নিউরোসার্জারিতে ১২ জন, সার্জারি ও শিশু বিভাগে ১০ জন করে অতিরিক্ত শিক্ষক আছেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া কাগজপত্রে দেখা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতাল এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পদে সংযুক্তিতে আছেন ২৯০ জন চিকিৎসক। এর বাইরে জুনিয়র ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট পদে সংযুক্তিতে আছেন শতাধিক চিকিৎসক।
তবে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইএনটি, জাতীয় বাতজ্বর ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র এবং সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশনে সংযুক্তিতে কোনো চিকিৎসক নেই।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল শীর্ষে: এই প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত শিক্ষকের পদের সংখ্যা ১০১টি, আছেন ১৭০ জন। স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যার শিক্ষকের পাঁচটি পদের বিপরীতে শিক্ষকসংখ্যা ২১। এর বাইরে নয়জন পরামর্শক চিকিৎসক সংযুক্তিতে আছেন। এ ছাড়া শিশু বিভাগে সাত, সার্জারি ও চর্ম বিভাগে পাঁচজন করে, রেসপিরেটরি মেডিসিনে চারজন, মেডিসিন ও নাক-কান-গলায় তিনজন করে, হেপাটোলজি, চক্ষু, নবজাতক ও শিশু বিভাগে দুজন করে, ব্লাড ট্রান্সফিউশন, অবেদনবিদ, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, শিশু সার্জারি, দন্ত, রেডিওথেরাপি ও অর্থোপেডিক সার্জারিতে একজন করে সংযুক্তিতে আছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মাকসুদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাপক পদে থাকা চিকিৎসকেরা একেকটি ইউনিটের (নির্দিষ্টসংখ্যক রোগীর দেখভাল) দায়িত্ব নেন। তবে সংযুক্তিতে থাকা চিকিৎসকদের ইউনিট পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয় না। মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরে সব বিভাগের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চাহিদা পাঠানো হয়নি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
নিয়ম অনুযায়ী, হাসপাতালে চিকিৎসকদের সকাল আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত সাড়ে ছয় ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর বাইরে চিকিৎসকেরা সরকারি হাসপাতালে ‘অন কল’-এ থাকেন (প্রয়োজন হলে ডাকা যাবে)। তবে আড়াইটার পর সাধারণত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বেশির ভাগই থাকেন না বা আসেন না। গত ৫ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত বৈঠকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সন্ধ্যাকালীন রাউন্ড চালুর সিদ্ধান্ত হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ও ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল: জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেসপিরেটরি মেডিসিনে সংযুক্ত আছেন ১৮ জন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৫৫টি পদ রয়েছে। সংযুক্ত আছেন নয়জন।
দেশজুড়ে মৌলিক বিজ্ঞানের শিক্ষকসংকট: ঢাকার বাইরে মেডিকেল কলেজগুলোতে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, প্রাণরসায়ন, কমিউনিটি মেডিসিন ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে শিক্ষকের সংকট রয়েছে। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এই পাঁচটি বিষয়ে পদের অতিরিক্ত শিক্ষক আছেন ১২ জন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে মৌলিক বিজ্ঞানে পদের অতিরিক্ত শিক্ষক আছেন ১২ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে সাতজন।
সংযুক্তির মূলে রাজনীতি?: গত বছরের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ‘দ্য অ্যাসেসমেন্ট অব রুরাল রিটেনশন পলিসিস ফর হেলথ ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর বাইরে প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং চিকিৎসকদের গ্রামাঞ্চলে বাধ্যতামূলক সেবা দিতে হবে। রাজনীতির কারণে দুটির কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি।
চিকিৎসকদের বদলির বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন প্রভাব বিস্তার করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব এম ইকবাল আর্সলান চিকিৎসকদের বদলি বা পদায়নে স্বাচিপ কোনো প্রভাব বিস্তার করে না বলে দাবি করেন।

No comments

Powered by Blogger.