সরকারের শত্রু সন্ত্রাস by মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু ও আবদুল্লাহ আল মামুন

নিজ দলের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে এখন প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করছে সরকার। সম্প্রতি সারা দেশে দলের নেতাকর্মীদের খুনাখুনিতে অতিষ্ঠ আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড সন্ত্রাস দমনে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের চিন্তাভাবনা করছে। গুটিকয়েক সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ সমর্থক-নেতাকর্মীর অপকর্মে সরকারের বিশাল অর্জন যাতে ম্লান হয়ে না যায়, সে জন্য জেলা ও থানা পর্যায়ে পুলিশকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে তিন ক্যাটাগরিতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নামের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
সম্প্রতি কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পাঁচ নেতা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই দলীয় নেতাকর্মীদের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি নেয়া হয়নি। ফলে তারা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে র‌্যাব-পুলিশকে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হতো না। ঘটত না কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সড়ক পরিবহন এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, সরকারের ভাবমূর্তিকে যারা ক্ষতিগ্রস্ত করবে তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল নিজ দলের সন্ত্রাসীরা এখন খুনাখুনিতে যুক্ত, মাঠের বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে এখন তারা (নিজ দলের সন্ত্রাসীরা) সরকারের মূল প্রতিপক্ষ কিনা? জবাবে সেতুমন্ত্রী বলেন, যারা অপকর্ম করবে তারাই আমাদের প্রতিপক্ষ, এরা জনগণেরও প্রতিপক্ষ। এদের কোনো দল নেই। তবে বিরোধী দল মাঠে অনুপস্থিত, সেটা মানতে নারাজ শাসক দলের প্রভাবশালী এ নেতা।
সাবেক আইজিপি এমএ কাইয়ুম শনিবার রাতে যুুগান্তরকে বলেন, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন এবং এ বিষয়টিকে যে গুরুত্ব দিচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে। তিনি বলেন, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তা আমাদের পুলিশ জানে। পুলিশকে স্বাধীনতা দিলে আগেই তারা এ কাজ করতে পারত। পুলিশ নিরপেক্ষ ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারলে আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের (কথিত বন্দুকযুদ্ধ) বিরোধিতা করে সাবেক এ পুলিশ-প্রধান বলেন, ধরে নিয়ে কাউকে মেরে ফেলা হবে এটা কেনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। পুলিশ বিভাগকে দলীয়করণ না করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া উচিত। আর এটার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
পুলিশ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুলিশকে জেলা ও থানা পর্যায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের তিন ক্যাটাগরিতে নামের তালিকা তৈরি করতে উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- টেন্ডার, চাঁদা ও দখলবাজি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের একটি তালিকা। শাসক দলের যেসব নেতাকর্মী বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মামলা আছে, সেসব মামলার বিস্তারিত অর্থাৎ কোন ধরনের মামলা রয়েছে সে তথ্য ও দলীয় পদবিসহ তাদের নাম এবং ক্লিন ইমেজের নেতাকর্মীদের নামের তালিকা পুলিশ সদর দফতরে পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জেলা ও থানা পুলিশের সহায়তায় এসবি (বিশেষ শাখা) এ তালিকা তৈরি করছে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা সারা দেশে বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের নেতাদের সতর্ক করছি। তাদের বলছি, যারা নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখেন তাদের অধিকতর ‘অ্যাকোমেটেড’ করতে। যাতে তারা কোনোভাবেই বঞ্চিত না মনে করেন এবং হতাশ না হন। একই সঙ্গে সংগঠনে যাতে কোনো ধরনের কোটারি সৃষ্টি না হয়- সে ব্যাপারেও সতর্ক করা হচ্ছে। সারা দেশে নিজেদের মধ্যে খুন-খারাবি বেড়ে যাওয়ায় সাংগঠনিকভাবে কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বপন আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সব স্তরের নেতাকর্মীকে এই বার্তা দেয়া হচ্ছে, ‘জনগণই সব ক্ষমতার উৎস।’ ফলে নিজেদের সংযম ও সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে।
মাগুরা, কুষ্টিয়া, ঢাকার হাজারিবাগ ও বাড্ডায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের খুনাখুনির পর সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি সন্ত্রাস দমনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কঠোর নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি মন্ত্রিসভার সদস্যদের হুশিয়ার করে দেন এই বলে যে, তারা যেন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষে কোনো ধরনের অনুকম্পা প্রদর্শন এবং তাদের ছাড়িয়ে নিতে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তদবির না করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, যারা প্রকৃত অপরাধী তারা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হতে পারে না। তারা নিজেদের প্রয়োজনে দলকে ব্যবহার করে। তিনি বলেন, সন্ত্রাসী যে রাজনৈতিক দলেরই হোক আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণে কাউকে একবিন্দু ছাড় দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর সোমবার রাতে সন্ত্রাসী পাকড়াওয়ে র‌্যাব ও পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেন। এতে কুষ্টিয়া ও মাগুরায় শাসক দলের দুই নেতা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ওই অভিযানে ছাত্রলীগের দুই নেতা নিহত হওয়ায় শাসক দলের অভ্যন্তরে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য ও ঢাকার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এ ঘটনায় প্রকাশ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অবশ্য তাপস এখন চুপচাপ রয়েছেন। সরকারের হাইকমান্ড থেকে তাপসকে সন্ত্রাস দমনে কঠোর অবস্থানের বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ঘটনার পর গাজীপুরের সালনায় রাজধানীর বাড্ডার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইদুল ইসলাম এবং কুষ্টিয়ায় জাকির হোসেন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। শাসক দলের এ দুই নেতার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ নানা অভিযোগ ছিল। বর্তমানে সন্ত্রাস দমনে আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
কুষ্টিয়ায় শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে বলা হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান লাবু ও সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে গাজীপুর থেকে আটক করেছে র‌্যাব। তবে র‌্যাব এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সবুজের অনুসারী নেতাকর্মীদের গুলিতে ১৫ আগস্ট সবুজ নামের এক আওয়ামী লীগকর্মী নিহত হন। এ ঘটনায় শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে প্রধান আসামি করে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজ কুষ্টিয়ায় মাদক ব্যবসা, স্বর্ণ, চোরাচালানসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গেছে। তার বিক্রি করা বিষাক্ত মদ খেয়ে ২০০৫ সালে বেশ কয়েকজন মারা গেলে একটি মামলা হয়। ওই মামলার কারণে দীর্ঘ সময় তিনি আত্মগোপনে থাকেন। এরপর ক্ষমতায় আসার আগ মুহূর্তে মামলা থেকে বাঁচতে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির পৃষ্ঠপোষকতায় জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। র‌্যাবের হাতে শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজ আটকের সংবাদে সেখানকার মানুষের মধ্যে স্বস্তি এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সবুজের মতো আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণকারী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিতে কুষ্টিয়ার সবুজের মতো শাসক দলের জেলা ও থানা পর্যায়ের নেতাদের আপত্তিকর কর্মকাণ্ডের বিষয় তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠকে ডিসিরা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, তদবিরসহ নানা অপকর্ম সম্পর্কে সরকারপ্রধানকে অবহিত করেন। গত সপ্তাহে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আইনশৃংখলা সংক্রান্ত কমিটির ত্রৈমাসিক সভাতেও একই ধরনের অভিযোগ করেন পুলিশ সুপাররা (এসপি)। তারাও শাসক দলের এসব সন্ত্রাসী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন।
ডিসি ও এসপিদের আশংকার মধ্যেই ২৩ জুলাই মাগুরায় ছাত্রলীগের দু’পক্ষের গোলাগুলিতে নাজমা খাতুন ও তার পেটের শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। এরপর সিলেট, মদন মোহন কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছুরিকাঘাতে আবু আলী, রাজধানীর বাড্ডায় হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান গামা, আওয়ামী লীগ নেতা শামসু মোল্লা এবং চাকরিজীবী ফিরোজ আহমেদ মানিককে, নিজ দলীয় প্রতিপক্ষের হাতে কুষ্টিয়ায় সবুজ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে রবিউল ইসলাম নামের দুই আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন। এছাড়া কালিয়াকৈরে স্থানীয় যুবলীগ সভাপতি রফিকুল ইসলাম এবং ঢাকায় যুবলীগের ওয়ার্ড নেতা আবদুল মান্নানকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে রাজধানীর হাজারীবাগে রাজা মিয়া নামের এক যুবককে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় ছাত্রলীগের সভাপতি। তারও আগে চাঁদপুরের কচুয়ায় জাতীয় শোক দিবসের চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে ভূঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায় যুবলীগ নেতাকর্মীরা।
ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ৫-৭ বছরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে বহু হতাহত হয়েছেন। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে র‌্যাবসহ আইনশৃংখলা বাহিনীকে তখন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বিএনপি আমলে বলেছিলাম, র‌্যাব বিএনপির জন্য ফ্রাঙ্কেইনস্টাইন হয়ে উঠবে, অনেক দেরিতে হলেও খালেদা জিয়া গত বছর র‌্যাবের বিলুপ্তি চেয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব এখন আওয়ামী লীগের জন্যও ফ্রাঙ্কেইনস্টাইন হয়ে উঠছে।
তিনি আরও বলেন, যে দেশেই আইনশৃংখলা বাহিনীকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য রাজনৈতিক অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেই দেশেই আগে হোক, পরে হোক এরা রাজনীতিবিদদের জন্য ফ্রাঙ্কেইনস্টাইন হয়ে উঠেছে। আগে হোক পরে হোক এরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আমরা এখন সেই জিনিসটাই দেখছি। বিএনপি এখন র‌্যাবের বিলুপ্তি চাইছে, আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এখন এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হলে এ পরিণতি হয় উল্লেখ করে শাহদীন মালিক বলেন, ‘আপনি যখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে যাচ্ছেন, তার মানে হল, নিয়মতান্ত্রিক পথে আপনি যাচ্ছেন না।’

No comments

Powered by Blogger.