শামসুন্নাহার নিজামীর জবাব

‘কামারুজ্জামানের চিঠি এবং জামায়াতের সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক বইটির সম্পাদনা করেছেন সমাজ ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান পরিচালক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। সমাজ ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র থেকেই বইটি প্রকাশিত হয়েছে। এ বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের লেখা সেই বহুল আলোচিত চিঠি। দীর্ঘ যে চিঠিতে তিনি জামায়াতে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ওই প্রস্তাবের জবাব হিসেবে সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় দুই পর্বের একটি নিবন্ধ লেখেন জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি শামসুন্নাহার নিজামী।
দ্বিতীয় পর্বে তিনি লিখেছেন, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের মাধ্যমে মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্বের অবসান ঘটানোর লক্ষ্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কাজ করে যাচ্ছে। এ কাজ কোনো মনগড়া বা আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে জামায়াতে ইসলামী নির্ধারণ করেনি। বরং কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ কাজের কথা পরিস্কার করে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে তৈরি করেছেন এ দায়িত্ব পালনের জন্য। যা কুরআনে কালামে পাকে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি দুনিয়াতে আমার প্রতিনিধি পাঠাব’।
এই প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন, ফেরেশতাদেরকে দেননি। ফেরেশতারা আল্লাহর কর্মচারি। আল্লাহ যে হুকুম তাদের দেন তার বাইরে কিছু করার ক্ষমতা বা এখতিয়ার আল্লাহ তাদেরকে দেননি। কিন্তু মানুষকে এ ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছেন। এ দায়িত্ব পালনের জন্য যুগে যুগে নবী-রসুল পাঠিয়েছেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মানবতার পারফেক্ট মডেল।
যেহেতু এ কাজের জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাই এ কাজ মানুষের জন্য ফরজ। দুনিয়ার মানুষের সকল রকমের অশান্তি ও বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর এটাই একমাত্র পথ। মানুষকে জুলুম-নির্যাতন ও যাবতীয় শোষণ থেকে মুক্তিদানের জন্য আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) কাজ করেছেন। মানুষ মানুষের দাস হবে না। সবাই একমাত্র আল্লাহর হুকুম মেনে চলবে। দাসত্ব বন্দেগী করবে একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহপাক বলেছেন ‘হে মানুষ আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই।’ (সূরা হুদ-৮৪)
‘তাদেরকে সবকিছু ছেড়ে, সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার করা এবং তারই আনুগত্য করে চলার আদেশ করা হয়েছে মাত্র।‘ (সূরা আল বাইয়্যেনাহ-৫)
নবী-রসুলগণের মাধ্যমে আল্লাহপাক যে জীবন বিধান পাঠিয়েছেন তার মূল কথাই হলো, আইন রচনা, নির্দেশ দান ও বিধান প্রণয়নের কোন অধিকার মানুষের নেই। এ অধিকার একমাত্র আল্লাহর। ‘আল্লাহ ছাড়া আর কারো নির্দেশ দান ও আইন রচনার অধিকার নেই। তাঁর আদেশ এই যে, আল্লাহ ছাড়া কারো বন্দেগী বা দাসত্ব কবুল করো না। বস্তুত এটাই সঠিক ও নির্ভুল জীবন ব্যবস্থা।’ (সূরা ইউসুফ-৪০) আইন রচনা করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। এ অধিকার কোন মানুষের নেই, এমনকি নবীদেরও নেই। নবী নিজেও একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলেছেন। নবীর অনুসরণ করা ছাড়া আল্লাহর হুকুম পালনও সম্ভব নয়। কুরআনের এ আয়াতগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি কোনো ব্যক্তি, বংশ পরিবার, শ্রেণী বা দল, এমনকি রাষ্ট্রও প্রভুত্বের অধিকারী নয়। আইন রচনা ও বিধান প্রণয়নের অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কোরো নেই। আল্লাহর দেয়া আইনের কোনোরূপ পরিবর্তন বা সংশোধন করার অধিকারও কারও নেই।
আল্লাহপাক নবী (সা.)-এর মাধ্যমে যে বিধান দুনিয়ায় পেশ করেছেন তাই ইসলামী রাষ্ট্রের চিরন্তন ভিত্তিগত আইন। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যও আল্লাহপাক নির্ধারণ করে দিয়েছেন: ‘আমি আমার নবীদেরকে সুস্পষ্ট বিধানসহ প্রেরণ করেছি। কিতাব ও ‘মিযান’ তাদেরকে আমি দান করেছি। এর সাহায্যে মানুষ সুবিচার ও ইনসাফ কায়েম করতে পারবে। আমি ‘লৌহ’ও দিয়েছি। এতে বিরাট শক্তি ও মানবতার অশেষ কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’ (হাদীদ-২৫) এ আয়াতে ‘মিযান’ শব্দটিতে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থার কথা বোঝানো হয়েছে। এ অনুযায়ী সমাজে সামাজিক সুবিচার কায়েমই এর লক্ষ্য, যা ছিল আম্বিয়ায়ে কেরামের একমাত্র কাজ। ‘এদেরকে আমি যদি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা এবং জনশক্তি দান করি তাহলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে, ভাল ও কল্যাণকর কাজ করবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে।’ (সূরা আল হাজ্ব-৪১)
কুরআনে কালামে পাকের এ আয়াতগুলো থেকে এ কথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য শুধু মানুষকে জুলুম-নিপীড়ন থেকে মুক্তি দেয়া ও দেশকে বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা করাই নয় বরং কুরআন অনুযায়ী সামাজিক সুবিচারের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। আল্লাহর বিধান অনযায়ী পাপ কাজের সমস্ত উৎস বন্ধ করা এবং পুণ্য ও কল্যাণের সমস্ত পথ খুলে দেয়া। সমাজ ও সংস্কৃতির প্রত্যেকটি দিক ও বিভাগকে এটি স্বীয় বিশিষ্ট নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংস্কারমূলক কর্মসূচি অনুযায়ী গঠন করে। অর্থাৎ মানুষের গোটা জীবনকে এর প্রভাবাধীন করে নেয় এবং এ ধরনের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান আল্লাহ ছাড়া আর কারও পক্ষেই দেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় এ কথাগুলো পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
মূলত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রচলিত অর্থে কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন। কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে এবং নির্দিষ্ট গঠনতন্ত্রের মাধ্যমে এ দল পরিচালিত হয়। বিরোধী কোন শক্তির পক্ষ থেকে কেউ আক্রমণ করল কি না তার মোটেও পরোয়া করে না জামায়াতে ইসলামী। অতীতে নবী-রাসুলগণও এ পরোয়া করেননি। বরং তাদের অবস্থা এমন ছিল যেন মৌচাকে ঢিল মেরে সেইখানে দাঁড়িয়ে থাকা, যেন সমস্ত মৌমাছিকে আক্রমণ করার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো। এ কাজ সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়। যারা এ উদ্দেশ্যকে নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে তারাই এ কাজের উপযুক্ত। এ আন্দোলনের কর্মী বা নেতা হলেই চলবে না বরং এর আদর্শের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। তাদেরকে হতে হবে কুরআন সুন্নাহর অন্তর্নিহিত ভাবধারা এবং এর খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞ। এ ব্যাপারে কোন বিশিষ্ট নাগরিক, প্রবীণ আলেম বা পণ্ডিত ব্যক্তির প্রাধান্য দেওয়া যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.