শান্তিকামী জাপানে যুদ্ধংদেহী আইন by জ্যারেড জেনসার ও মিশেল বিগ্রনোন

সেই ১৯৩০-এর দশকের মধ্যভাগে জাপানের তৎকালীন জেনারেল ও যুদ্ধমন্ত্রী সাদাও আরাকি বলেছিলেন, ‘জাপানের লক্ষ্য হচ্ছে এশিয়া, দক্ষিণ সাগর ও চূড়ান্ত পর্যায়ে সারা পৃথিবীর সর্বপ্রধান শক্তি হওয়া।’ ১৯৪৫ সালে টোকিও উপসাগরে ইউএসএস মিজৌরি যুদ্ধজাহাজে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার অবসান ঘটে। তারপর তারা মেইজি সংবিধানের জায়গায় এক শান্তিকামী সংবিধান প্রণয়ন করলে দেশটি গণতন্ত্র, শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক অদৃষ্টপূর্ব যুগে প্রবেশ করে।
আর আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৭০ বছর পর জাপানের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে যে নিরাপত্তা বিল পাস হয়েছে, তাতে দেশটির শান্তির যুগের অবসান ঘটার ইঙ্গিত রয়েছে। এর মাধ্যমে শিনজো আবে ও তাঁর ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) বিদ্যমান আইন সংশোধন করেছে, এর ফলে জাপানের সেনাবাহিনী বিদেশে যুদ্ধ করতে যেতে পারবে যদি:
১) জাপান বা তার কোনো ঘনিষ্ঠ মিত্র আক্রমণের মুখে পড়ে, আর এর ফলে জাপানের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে বা সেটা তার জনগণের জন্য পরিষ্কার হুমকি হয়ে দাঁড়ায়;
২) সেই আক্রমণ প্রতিহত করার এবং জাপানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ও তার জনগণের সুরক্ষার আর কোনো যথাযথ উপায় না থাকে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘শক্তি প্রয়োগের মাত্রা প্রয়োজনীয় ন্যূনতমের মধ্যে সীমিত রাখা হবে’।
যে আইনের কারণে সেনাবাহিনী আরও শক্তিশালী হবে, জনগণের রুষ্ট প্রতিবাদের মুখেও তার সমর্থনে আবে বলেছেন, এই আইন ‘যুদ্ধে যাওয়ার জন্য’ প্রণয়ন করা হয়নি, এটা করা হয়েছে ‘যুদ্ধ প্রতিরোধের’ ক্ষেত্রে নিরোধক হিসেবে। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, এই আইনের কারণে জাতিসংঘের সম্মিলিত আত্মরক্ষার মতবাদের আলোকে জাপান তার মিত্রদের আরও ভালোভাবে সমর্থন দিতে পারবে। জাতিসংঘের এই মতবাদে সশস্ত্র আক্রমণ হলে ‘একক বা যৌথভাবে আত্মরক্ষার’ বিধান আছে। কিন্তু তিনি এটা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষায় জাপানের সহায়ক ভূমিকা কেন যুদ্ধ রোধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে গণ্য হবে না।
দেশের ভেতরে এই আইনের বিরোধিতাকারীদের মধ্যে আছেন ১০ হাজারেরও বেশি বিদ্বজ্জন। তাঁরা জোর গলায় বলছেন, এই আইনটি অসাংবিধানিক। জাপানের সংবিধানের ৯ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধ করা জাতির সার্বভৌম অধিকার—এ ব্যাপারটি জাপানের জনগণ চিরকালের জন্য পরিত্যাগ করেছে। আন্তর্জাতিক বিরোধ নিরসনে শক্তি প্রয়োগ ও তার হুমকির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য...স্থল, জল, আকাশ বা যুদ্ধের কোনো রকম মাধ্যমকেই অর্থায়ন করা হবে না।’ দেশটির সংবিধানের ৯৬ ধারায় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সংবিধানে সংশোধনী আনতে হলে অধিকাংশ জনগণের অনুসমর্থনের আগে সংবিধানের দুই কক্ষেই দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তা পাস হতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় গেলে আবে অবশ্যই ব্যর্থ হবেন, তিনি তা জানেন। কারণ, জাপানের ৬১ শতাংশ মানুষ এই আইনের বিপক্ষে।
উপরন্তু এই বিধানের অস্পষ্টতার জন্য গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধীদের যুক্তি হচ্ছে, এই আইনে এমন কিছু অস্পষ্ট ব্যাপার আছে, যার কারণে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকার আক্রমণের উদ্দেশ্যে সৈন্য নামালে আইনটি ব্যাখ্যায় অতিরিক্ত স্বাধীনতা ভোগ করবে। জাপানের ইতিহাসের আলোকে জাপানি জনগণের এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে প্রজ্ঞা আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৭০ বছর পর জাপানের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে যে নিরাপত্তা বিল পাস হয়েছে, তাতে দেশটির শান্তির যুগের অবসান ঘটার ইঙ্গিত রয়েছে শেষবার যখন জাপানের সেনাবাহিনী বিদেশের মাটিতে পা দিয়েছে, তখন তারা জমি দখল করেছে, নিজ দেশের সঙ্গে অন্য দেশকে সংযুক্ত করেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হানা দিয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করেছে এবং বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। সরকারের নির্দেশনায় জাপানি সামরিক বাহিনী ৩০ লাখ থেকে ১ কোটি চীনা, ইন্দোনেশীয়, কোরীয়, ফিলিপিনো ও ইন্দো চীনা মানুষ হত্যা করেছে। পুরো এশিয়াতেই জাপান মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তারা লাখ লাখ নারীকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করেছে। দেশটির সেনাবাহিনীর ৭৩১ ইউনিট হারবিন ও মাঞ্চুকুয়োতে অবর্ণনীয় আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। সেখানে দেশটির বিজ্ঞানীরা জীবিত কারাবন্দীদের শরীর চিরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাসহ তাঁদের ওপর আরও অবর্ণনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। এসব নৃশংসতার নথিপত্র সংরক্ষিত আছে। কিন্তু জার্মানদের মতো তারা অতীতের পাপ থেকে শিক্ষা নেওয়া বা তার দণ্ড দিতে শেখেনি। আধুনিক জাপানিরা তা স্বীকার করতে, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে বা সেখান থেকে শিখতে অনাগ্রহী।
জাপানের যুদ্ধাপরাধ আড়াল করার দীর্ঘ ইতিহাসের কারণে বিশেষ করে আবে ও এলডিপির পক্ষে এই পরিবর্তনের জন্য চাপাচাপি করাটা বিব্রতকর ব্যাপার হবে। ১৯৯৫ সালে হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের একটি প্রস্তাবে এলডিপির ২২১ জন সদস্য জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্যাসিফিক যুদ্ধটা ছিল আসলে উপনিবেশায়িত এশিয়াকে স্বাধীন করার জন্য।’ বিচারমন্ত্রী নাগানো শিগেটো দাবি করেছিলেন, ‘নানজিং হত্যাকাণ্ড এক মিথ্যা কাহিনি’, বেশ চমৎকার দাবিই ছিল এটা। এরপর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওদিকে ২০০৭ সালে আবে দাবি করেছিলেন, ‘কমফোর্ট উইমেনদের’ জোর করে জাপানি সাম্রাজ্যবাদী সেনাবাহিনীর যৌনদাসী বানানো হয়নি। এ বছরের শুরুর দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে আবে সে জায়গা থেকে সরে এসে কমফোর্ট উইমেনদের ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি শুধু বলেন, তিনি তাদের দুঃখ-কষ্টের জন্য ‘গভীরভাবে দুঃখিত’।
ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে এই আইনটি এখন জাপানের হাউস অব কাউন্সিলরসে যাবে। জাপানের সংসদের এই কক্ষকে ‘কাণ্ডজ্ঞানের পীঠ’ বলা হয়, আবার তাকে ‘যৌক্তিক রাজনীতির’ ক্ষেত্র হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়, কারণ এর সদস্যরা ছয় বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হন। ডায়েটের উচ্চকক্ষে এলডিপি জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও এমন নজিরও আছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আসা আইন হাউস অব কাউন্সিলর্স বাতিল করে দিয়েছে। ২০০৫ সালে এলডিপির বিদ্রোহী সদস্যরা ডাক যোগাযোগ বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে ভোট দিতে বিরোধী জোটে যোগ দিয়েছিলেন। জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি এলডিপির বিদ্রোহী সদস্যদের বহিষ্কার করার পর আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন, আর তাতে তিনি বিপুল বিজয়ও লাভ করেন।
এবারের পরিস্থিতি কিন্তু নাটকীয়ভাবেই ভিন্ন। এমনকি আবে যদি তাঁর জোট ধরে রাখেন এবং হাউস অব কাউন্সিলরসের বাধা পেরিয়েও যান, তাহলেও তিনি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অথবা পরবর্তীকালে জাপানের সুপ্রিম কোর্ট আইনটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে পারেন। ব্যাপক জনরোষের মুখে এলডিপির ঐক্য টেকে কি না, সেটাই দেখার বিষয়, কারণ জাপানের মানুষেরা এই আইনটিকে রাজনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক মনে করছে। এ মুহূর্তে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বিজ্ঞোচিত যে কাজটি করতে পারেন, সেটি হচ্ছে জনগণের প্রজ্ঞার কাছে নতি স্বীকার করা।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে নেওয়া
জ্যারেড জেনসার: কলামিস্ট; মিশেল বিগ্রনোন: জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.