এই শিশুদের রক্ষা করবে কে? by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া

সিরিয়ার দুই শিশুযোদ্ধা। ছবি: রয়টার্স
‘আমি যদি বড় হতাম, তাহলে যুদ্ধ করতাম’—এই অকপট উক্তি এক শিশুর। বয়স মাত্র ১৪ বছর। গভীর জীবনবোধ এখনো তৈরি হয়নি। অথচ সে কালাশনিকভ রাইফেল চালাতে পারে। ডেনিস নামের এই শিশু এখন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের কাছে। বন্দুক চালানো আর যুদ্ধে কিছু কলাকৌশল রপ্ত হলেই সে লড়বে ইউক্রেনের সেনাদের বিরুদ্ধে।
যুদ্ধের ময়দানে যেতে একপায়ে খাঁড়া ডেনিস। সে গুলি ছুড়তে চায়। ট্যাংক দেখতে চায়। অথচ এ বয়সে তার কিশোরসুলভ এমন চপলতায় মেতে থাকার কথা, যেখানে এ ধরনের সংঘাতের কোনো স্থান নেই। তার হাতে থাকার কথা খেলার সামগ্রী, প্রাণঘাতী অস্ত্র নয়।
যুদ্ধকবলিত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ডেনিসের মতো এমন অনেক শিশুকে যুদ্ধের জন্য তৈরি করছে বিদ্রোহীরা। ইউক্রেনে সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য শিশুদের যে তৈরি করা হচ্ছে, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অনেক আগেই শোনা গিয়েছিল। তবে গত জানুয়ারিতে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এ ধরনের প্রশিক্ষণের কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
সম্প্রতি এএফপিসহ অন্যান্য বার্তা সংস্থার খবরে »বলা হচ্ছে, দনেতস্কের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খার্তসিজ্ক এলাকায় বিভিন্ন স্কুলে শিশু শিক্ষার্থীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
যুদ্ধে এভাবে শিশুদের ব্যবহারের ঘটনা নতুন নয়। বিশ্বের সব দেশেই তোতাপাখির মতো বলা হয়, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের আদর সোহাগে শিক্ষাদীক্ষায় লালন-পালন করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু হীন স্বার্থ হাসিলে অবলীলায় তাদের প্রাণ হরণে দ্বিধা নেই কারও।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, এ মুহূর্তে বিশ্বের ২৪টি দেশে প্রায় আড়াই লাখ শিশুকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে যুদ্ধে জড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই আফ্রিকান শিশু। এক জরিপে দেখা গেছে, শিশু যোদ্ধাদের বয়স সাত থেকে ১৮ বছর। কেবল অস্ত্র চালানোর জন্যই যে তাদের নেওয়া হয়, তা নয়। আরও যেমন-রান্নাবান্না, চরবৃত্তি, আত্মঘাতী হামলা চালানো, মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার, যৌন লালসা চরিতার্থ ইত্যাদিতে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
সাধারণত দরিদ্র, বাস্তুচ্যুত ও ভাসমান পরিবারের শিশুদের যোদ্ধা হিসেবে নেওয়া হয়। অনেক সময় ভালো কাজ দেওয়ার কথা বলে পটানো হয় শিশুর অভাবী বাবা-মাকে। দেওয়া হয় এক থোক লোভনীয় অর্থ। কখনোবা শিশুটিকেই লোভনীয় খাবার, পোশাক বা পছন্দের জিনিস দিয়ে ফাঁদে ফেলা হয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এক লাখ ২০ হাজারের বেশি শিশুযোদ্ধা যুদ্ধে লিপ্ত। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, বুরুন্ডি, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, লাইবেরিয়া, রুয়ান্ডা, সুদান, দক্ষিণ সুদান, উগান্ডা ও সিয়েরা লিওন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, দক্ষিণ সুদানে খোদ সরকারই ১৩ বছর বয়সী শিশুদের যোদ্ধা হিসেবে নিয়োগ করছে।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, থাইল্যান্ড, সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, ইয়েমেনে ব্যাপক হারে শিশুযোদ্ধাদের ব্যবহারের তথ্য রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধবিষয়ক সহিংসতায় কমপক্ষে আড়াই হাজার শিশু মারা গেছে।
শিশুযোদ্ধাদের সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যবহার আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে। এই দুটি দেশে তালেবান তাদের আত্মঘাতী হামলাকারী হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
ব্রিটিশ চ্যানেল ফোরে এমন এক আফগান শিশুর সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হয়, যাকে আত্মঘাতী হামলাকারী হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল তালেবান।
ওই এতিম শিশুর নাম নিয়াজ। তালেবান যখন তাকে দলে ভেড়ায়, তার বয়স ছিল মাত্র আট বছর। নিয়াজের বাবা ছিলেন মেষপালক। একদিন তালেবান জঙ্গিরা এসে আশ্রয় নেয় তাদের বাড়িতে। এ সময় মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী ওই গ্রামে হামলা চালায়। বোমা এসে পড়ে নিয়াজদের বাড়িতে। তার বাবা-মা মারা যান। নিয়াজের তখন আপন বলতে আর কেউ রইল না। তালেবান নেতা নিয়ে গেলেন ওকে। ভালো ভালো খাবার খাইয়ে অস্ত্র চালানো শেখালেন। আত্মঘাতী হামলাকারী হতে তালিম দিলেন। একদিন নিয়াজকে একটি তল্লাশি চৌকিতে গিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালাতে বলা হলো। তার দুহাত ভরে দেওয়া হলো কয়েন।
ছোট্ট নিয়াজের মনে প্রশ্ন জাগল, সে মরে গেলে এই কয়েন দিয়ে কী হবে? প্রশ্নটা করেও বসল। জবাব এল, এ কাজ করলে বেহেশতে যেতে পারবে সে। নিয়াজ বের হলো ঠিকই, কিন্তু গেল এক থানায়। পুলিশকে খুলে বলল সব। এখন সে লশকর গাহের একটি এতিমখানায় বড় হচ্ছে।
নিয়াজের মতো শিশুযোদ্ধাদের এমন করুণ কাহিনি ভূরি ভূরি। এসব কাহিনির শুরু আছে, শেষ নেই।

No comments

Powered by Blogger.