বিতর্কিত মন্ত্রীদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দাবি টিআইবির

দুর্নীতির অভিযোগের কারণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা উচিত বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। পদত্যাগ করলে এটি একটি নজির হতো বলে মনে করে সংস্থাটি। গতকাল দুপুরে নিজস্ব কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘জাতীয় যুব-সততা জরিপ ২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশকালে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান একথা বলেন। ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার দুর্নীতির বিষয়টি বিচারাধীন বলে উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তার দুর্নীতির বিষয়টি এখনও বিচারাধীন। তাই শুধু এটুকু বলা যায় যে, এ ক্ষেত্রে তিনি যদি পদত্যাগ করতেন, তাহলে ভাল হতো। এটি একটি নজির হতো। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একইভাবে গম নিয়ে খাদ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এখন পর্যন্ত এটা প্রমাণিত যে গমের মান ততটা ভাল ছিল না। তাই খাদ্যমন্ত্রীরও উচিত ছিল স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা। তিনি বলেন, এরপর যদি তদন্ত ও বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে প্রমাণ হতো যে এই ঘটনার সঙ্গে তারা জড়িত নন, তাহলে তারা অনেক বেশি জনপ্রিয় হতেন। মানুষ তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করত। গম কেলেঙ্কারির সঙ্গে দায়ীদের বিচারের আওতার আনার দাবি জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী আরও বলেন, গমের বিষয়টা অনেক আলোচিত একটি বিষয়। খুবই দুঃখজনক। আমি মনে করি যে, অন্তত নিজেদের স্বার্থে এটাকে আর এভাবে অবমূল্যায়নের চেষ্টা না করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষ অনুসন্ধান করে, যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ
সম্মেলনে আজ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক
ইফতেখারুজ্জামান বক্তব্য রাখেন। ছবি: সাহাদাত পারভেজ
রাজনীতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করে ৮৬ শতাংশ যুব
রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসাবে চিহ্নিত করেছে যুবরা। একই সঙ্গে সরকারি সেবাখাতগুলোকে বেসরকারি সেবা খাতগুলোর তুলনায় বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করছে তারা। ৮৬ শতাংশ যুব মনে করে দেশের রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত। ৬৬ শতাংশ যুব জানিয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি প্রকাশিত ‘জাতীয় যুব-সততা জরিপ ২০১৫’- শীর্ষক প্রতিবেদনে এই চিত্র পাওয়া গেছে। গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল তুলে ধরেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনজুর-ই-খোদা এবং শাম্মী লায়লা ইসলাম। বিভিন্ন সেবা খাতে যুবদের দুর্নীতির অভিজ্ঞতা, দুর্নীতি প্রতিরোধে যুবদের জ্ঞান, আগ্রহ ও অঙ্গীকারের মাত্রা যাচাইয়ের লক্ষ্যে জরিপটি পরিচালিত হয়। এই জরিপে ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের ব্যক্তিদের যুব হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। জরিপে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা থেকে ৩১টি জেলার মোট ৩হাজার ৬৫৬ জন তথ্যদাতার অভিমত সন্নিবেশিত হয়। উত্তরদাতাদের এক-তৃতীয়াংশ হলো নারী। জরিপে বলা হয়, যুবরা রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। একই সঙ্গে সরকারি সেবাখাতগুলোকে বেসরকারি সেবাখাতগুলোর তুলনায় বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করছে। ৮৬ শতাংশ যুব মনে করে দেশের রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত। ৬৬ শতাংশ যুব জানিয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
জরিপের ফল অনুযায়ী, যুবদের প্রায় সবাই সততার অভাবকে দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের জন্য একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কখনও দুর্নীতি করে না, কোন পরিস্থিতিতেই ঘুষ নেয়ও না, দেয়ও না এমন মানুষকে প্রায় ৯৮ শতাংশ যুব সৎ বলেছে। অধিকাংশ যুবরাই ধনী হওয়ার চেয়ে সৎ হওয়াকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। অসৎ ব্যক্তির চেয়ে সৎ ব্যক্তির জীবনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে জরিপে বেশির ভাগ যুবরা একমত পোষণ করেছে। আবার গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পাস করা বা গুরুত্বপূর্ণ কোন চাকরি পাওয়ার জন্য ব্যর্থ হতে পারেন জেনেও কোন প্রতারণার আশ্রয় নেবেন না বরং সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলে মনে করেন জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭৩ শতাংশ নারী ও ৬৫ শতাংশ পুরুষ। কোন আত্মীয় নিয়ম-বহির্ভূতভাবে ভাল কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, অথবা কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিতে চাইলে বেশির ভাগ যুবই সরাসরি না বলবেন বলে জরিপে জানানো হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতি দমন ও সততা প্রতিষ্ঠায় যুবদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে ৮২ শতাংশ যুব মতামত দিয়েছে। ৮০ শতাংশ দুর্নীতির মুখোমুখি হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করবেন এমন অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন। বেশির ভাগ যুব জানিয়েছে পরিবার, বন্ধু ও সহকর্মীরা সততার ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে তাদের প্রভাবিত করে। জরিপ অনুযায়ী, সততা সম্পর্কে যুবদের ধারণার মাত্রা বেশ স্বচ্ছ হলেও বাস্তবে সততা চর্চার ক্ষেত্রে যুবদের একটি বড় অংশের মধ্যে বিপরীত বা নেতিবাচক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। দেশের বিদ্যমান দুর্নীতিবিরোধী আইন-কানুন, বিধিমালা সম্পর্কে জানেন মাত্র ১ শতাংশ এবং ৫৮ শতাংশ কিছুই জানে না বা তাদের কাছে এ সম্পর্কে কোন তথ্য নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। জরিপের ফল অনুযায়ী, সততা সম্পর্কে জোরালো নৈতিক ধারণা থাকা সত্ত্বেও যুবদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাস্তব জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সততা বিসর্জন দিতে বা সমঝোতা করতে রাজি আছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা দুর্নীতি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যারা অভিযোগ করতে আগ্রহী নয় তাদের মধ্যে ৬২% যুব মনে করে এ ধরনের অভিযোগে কোন কাজ বা ফল হবে না। গবেষণার ছয় দফা সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করে এর মাধ্যমে তরুণদের সামনে এর সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন ও শাস্তি থেকে অব্যাহতির সংস্কৃতি বন্ধ করা। যুবদের মধ্যে সততার প্রসার ও চর্চার বিষয়টিকে জাতীয় যুব নীতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে এর কার্যকর বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ করা এবং জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সততা প্রতিষ্ঠায় যুবদের ভূমিকা ও কর্মপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা। এছাড়া যুবদের জন্য দুর্নীতির অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়া ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত সৃষ্টি করা। পাঠ্যক্রমে বিদ্যমান সততা ও দুর্নীতি দমন বিষয়ক শিক্ষা আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা। যুবদেরকে মাঝে সততা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সকল অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে সমন্বিত কর্মসূচি ও প্রচারাভিযান কর্মসূচি গ্রহণ ছিল অপরাপর সুপারিশের অন্তর্ভুক্ত। সভাপতির বক্তব্যে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, আমাদের সমাজে যুবদের সংখ্যা এখন অনেক বেশি এবং তাদের এত বড় একটি অংশ বলছে, তারা এসব বিশ্বাস করে, কিন্তু চর্চা করতে পারে না। তাহলে আমাদের কত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে তারা যে এ চর্চা যাতে করতে না পারে তার জন্য দায়ী উপাদানগুলো কী কী। এগুলো দূর করার যে চেষ্টা সেটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিকসহ দেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রতিটি আন্দোলনে তরুণদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। কিন্তু অধিকাংশ যুবদের মধ্যে দুর্নীতি সম্পর্কে ধারণা কম। অনেকেই অন্য কোন উপায় নেই জেনে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। সে বিষয়টি মাথায় রেখে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি তরুণদের মধ্যেও দুর্নীতিবিরোধী চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্তদের যুবদের ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

No comments

Powered by Blogger.