এটিএম বুথে জাল নোট, দায় কার? by হামিদ বিশ্বাস

ঈদকে ঘিরে বাজারে জাল নোটের ছড়াছড়ি। বেসামাল হয়ে উঠছে জালনোট কারবারিরা, যতই ঘনিয়ে আসছে ঈদ। ইতিমধ্যে দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থান থেকে একাধিক জালনোটচক্রকে গ্রেপ্তার করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। সব মিলিয়ে অর্ধকোটি টাকার জাল নোট উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। গত এক বছর ধরে পুলিশের সাহায্যে এসব টাকা উদ্ধার করা হয়। টাকা নিয়ে কারবার করা জালিয়াত চক্র নানা উপায়ে জাল নোট ছড়িয়ে দিচ্ছে বাজারে। সে কারণে ব্যাংকের নগদ লেনদেন, বিভিন্ন বাণিজ্যিক লেনদেন ও এটিএম বুথে পাওয়া যাচ্ছে জাল নোট। জাল নোটের ছড়াছড়ির কারণে মাঝে মধ্যে ব্যাংকের এটিএম বুথেও এমন নোট পেয়ে বিপাকে পড়ছেন গ্রাহকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত ৫৪,৮৭,০০০ লাখ টাকার জাল নোট ধরা পড়েছে। বছরজুড়ে মোট ১৫৭টি কেস জমা পড়ে। এতে ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার মোট প্রায় ৭ হাজার পিস নোট রয়েছে। পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, ধরা পড়া জাল টাকার মধ্যে ৫০ টাকার ১৩০ পিস, ১০০ টাকার ১৩২০ পিস, ৫০০ টাকার ২৩২৫ পিস ও ১০০০ টাকার ৪১৮৬ পিস নোট রয়েছে। ব্যাংকারদের মতে, জাল কারবারিরা ধরা পড়লেও সাক্ষীর অভাবে তারা উপযুক্ত শাস্তি পায় না। এ কারণে ছাড়া পাওয়ার পর একই ব্যক্তি আবার জাল নোট ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে জাল নোট বিষয়ে ১৪৫ মামলা হয়েছে। মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৩৩টি। বছরের পর বছর এসব মামলা চললেও তা থেকে যাচ্ছে অনিষ্পন্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি বিভাগ ও মতিঝিল অফিসের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল ইসলাম খান বলেন, জাল টাকার মামলা বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। তারপর সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে অথবা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীরা বের হয়ে যায়। সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংক কোন জাল টাকা ধরে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকার জাল নোট নিয়ে আসে পুলিশ। ব্যাংক যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট পুলিশসহ জালকারবারির বিরুদ্ধে মামলা করে। এ মামলা চলতে থাকে দীর্ঘ দিন।  বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, বড় উৎসবের আগে কেনাকাটার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া নতুন নোট ছাড়াকে কেন্দ্র করে জাল নোটের কারবারিরা সক্রিয় হয়ে উঠে। তবে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন শপিং মলে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিনের পাশাপাশি জনসচেতনতা গড়ে তোলায় জাল নোটের প্রকোপ আগের তুলনায় কমেছে। জাল নোট প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে- আসল নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সংবলিত এক লাখ পিস হ্যান্ডবিল বিতরণ। একই হ্যান্ডবিল ব্যাংকগুলোর উদ্যোগে প্রয়োজন মতো ছাপিয়ে বিতরণ। সাধারণত ১০০, ৫০০ ও ১০০০ হাজার টাকা মূল্যমানের নোট বেশি জাল হয়। সে কারণে হ্যান্ডবিলের পাশাপাশি এসব নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য বিষয়ক পোস্টার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ইউএনও অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের অফিসের নোটিশ বোর্ডে টানানোর ব্যবস্থা করা হয়। সচেতনতা বাড়াতে রমজান মাসজুড়ে প্রতি সপ্তাহে আসল ব্যাংক নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সংবলিত বিজ্ঞাপন অন্তত পাঁচটি পত্রিকায় প্রচার করা হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তরফে দাবি করা হয়। অন্যদিকে ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর মাধ্যমে এবারও দেশের গুরুত্বপূর্ণ শপিং মলগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া গত বছরের রমজানে ঢাকাসহ সারা দেশের বড়-বড় মার্কেটে সরবরাহ করা ১৩০টি মেশিন কাজে লাগানোর জন্যও বলা হয়। সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বিভিন্ন সময়ে পাঁচ শতাধিক জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব মেশিনের পাশাপাশি নতুন চাহিদা দিলে তাও সরবরাহ করার অঙ্গীকার করা হয়। ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমান নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো- প্রতিটি নোটের মূল্যমান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো সংবলিত নিরাপত্তা সুতা থাকে। নোটটি চিত করে ধরলে মূল্যমান ও লোগো দেখা যায়। কাত করে খাড়াভাবে ধরলে তা কালো দেখায়। আসল নোটের এ নিরাপত্তা সুতা অনেক মজবুত যা নোটের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে জাল নোটের নিরাপত্তা সুতা নখ দিয়ে নড়াচড়া করলে উঠে যায়। প্রত্যেক প্রকার নোটের উপরের ডান দিকের কোনায় ইংরেজি সংখ্যায় লেখা মূল্যমান রঙ পরিবর্তনশীল কালি দিয়ে মুদ্রিত। জাল নোটে ব্যবহৃত কালি চকচক করলেও তা পরিবর্তন হয় না। আসল নোটের উভয় পাশের ডিজাইন, মধ্যভাগের লেখা, নোটের মূল্যমান ও ৭টি সমান্তরাল সরলরেখা উঁচু-নিচু বা খসখসেভাবে মুদ্রিত। এসব বৈশিষ্ট্য জাল নোটে সংযোজন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে বেশ কিছু ব্যাংকের এটিএম বুথে জাল নোট বের হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে দেশী ব্যাংক জালনোট সমস্যার দ্রুত সমাধান করলেও বিদেশী ব্যাংকের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় গড়িমসি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর বিদেশী স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মতিঝিল বুথে ১০০০ টাকার জাল নোট বের হয় বলে একজন গ্রাহক অভিযোগ করেন। একই ব্যাংকের মোহাম্মদপুরের রিং রোড বুথে পাওয়া যায় আরও ১০০০ টাকা। এসব টাকা গ্রাহক ফেরত পেয়েছে কি-না তা জানা যায়নি। তবে ডাচ্‌ বাংলা ব্যাংকের লালমাটিয়া মহিলা কলেজ বুথের ৫০০ টাকা ও রিং রোড বুথের ১০০০ টাকা গ্রাহক ফেরত পেয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে। এটিএম লেনদেন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও বড় কোন ঘটনা চলতি বছরে ঘটেনি বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাবি করেছে। এ ছাড়া এটিএম বুথে জাল টাকা বের হলে তাৎক্ষণিক করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ব্যাংককাররা। তারা বলেন, নকল নোট হাতে আসা মাত্র প্রথমেই নোটের নম্বর ও নিজেকে সিসি ক্যামেরার (গোপন ক্যামেরা) সামনে উপস্থাপন করা। এরপর এটিএম কাউন্টারের সিকিউরিটি গার্ডের কাছে গিয়ে সব কিছু জানিয়ে তার রেজিস্টারে একটি অভিযোগ লেখাতে হবে। পারলে গার্ডকে দিয়ে সই করিয়ে তার একটি নকলপত্র যোগাড় করে রাখা। সমস্ত নথিপত্র নিয়ে এরপর থানায় গিয়ে আবার আরও একটি অভিযোগ ও যে ব্যাংকে এটিএম থেকে নকল নোট পাওয়া গেছে সে ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা। কারণ প্রত্যেক এটিএম বুথে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর দেয়া থাকে। ব্যাংকে গিয়ে নোটটা যে নকল সে স্ট্যাম্প ব্যাংক থেকে লাগানো। ব্যাংক এরপর সমস্তটা রেজিস্টারে রেকর্ড করে একটি রশিদ দেবে এবং প্রশাসনের সাহায্যে এটিএম থেকে এই ধরনের জাল নোট বেরুনো বন্ধ করবে। মনে রাখতে হবে, এমন পরিস্থিতিতে দলিল প্রমাণ ছাড়া এটিএম বুথ ছাড়লে পরে  অভিযোগ করলেও ব্যাংক কোন সহযোগিতা করতে পারবে না। এ বিষয়ে ইস্টার্ন ব্যাংকের কনজ্যুমার ব্যাংকিংয়ের প্রধান নাজিম এ চৌধুরীর পরামর্শ হচ্ছে- জাল নোট দেখার পর কিছু না করে আপনি চলে গেলেন, পরে কিছু মেলানো যাচ্ছে না; তখন আপনাকে আমরা কোন সাহায্যও করতে পারবো না। সুতরাং উপরিউক্ত পরামর্শগুলো আপনাকে মেনে চলতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.