সূর্য না ডোবার দেশে রোজা

গ্রীষ্মকালে ফিনল্যান্ডের দিন অনেক বড়। তখন মুসলমানদের জন্য রোজা রাখা খুবই কষ্টকর। এখানে এবারের পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে জুনের মাঝামাঝি, গত বছরের তুলনায় চন্দ্রমাসের হিসেবে ১১ দিন আগে। ইসলামিক দিনপঞ্জিতে রমজান সবচেয়ে পবিত্র মাস। এ মাসে ফিনল্যান্ডের ধর্মপ্রাণ প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারী সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার খাদ্য পানীয়, ধূমপান থেকে বিরত থাকেন। গ্রীষ্মকালে এখানে দিনের পরিধি বাড়ে। ফিনল্যান্ডের উত্তরাংশের শহর ‘উতস্ইয়কি’এর সর্ব উত্তরের ‘নুয়রগাম’ গ্রামে সূর্যোদয় হয়েছে মে মাসের ১৫ তারিখের রাত্র একটা ৩২ মিনিটে আর সূর্যাস্ত হবে আগামী ২৯ জুলাই রাত্র ১২টা ৪২ মিনিটে। অর্থাৎ ফিনল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের শহর উতস্ইয়কির আশে পাশের কোনো এলাকাতেই আড়াই মাস সূর্য কখনোই সম্পূর্ণভাবে অস্ত যায় না। এভাবে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকলে দেখা যায় সেখানে দিনের পরিধি ক্রমান্বয়ে ছোট হতে থাকে। এবার রমজান মাসে ফিনল্যান্ডের সর্ব দক্ষিণের শহর হেলসিংকিতে রাত ১১টার দিকে সূর্য ডুবলেও সূর্যোদয় হয় ভোর চারটায় অর্থাৎ মাত্র পাঁচ ঘণ্টার জন্য সূর্য অস্ত যায়। তাই ফিনল্যান্ডের মুসলমানরা পবিত্র রমযান মাসে রোজা পালনের ক্ষেত্রে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। উত্তরের শহরগুলির যেখানে সূর্য কখনোই সম্পূর্ণভাবে অস্ত যায় না, সেখানে ওই খানের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সূর্যের উপরের দিকে ওঠার সময় থেকে নিচে নামার সময় পর্যন্ত রোজা পালন করেন। একই ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করেন ফিনল্যান্ডের নিকটবর্তী স্ক্যান্ডিনেভিয়ান মুসলমানরা। ইসলাম সোসাইটি অব নর্দার্ন ফিনল্যান্ডের সভাপতি ইমাম আব্দুল মান্নান বলেন, “মিসরীয় ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, রমজানে দিনের বিস্তৃতি যদি ১৮ ঘণ্টার বেশি হয় তাহলে তারা রোযা পালনের ক্ষেত্রে মক্কা অথবা মদিনা অথবা নিকটবর্তী মুসলিম দেশের সময়সীমা অনুসরণ করতে পারেন।”   অপরদিকে সৌদি বিশেষজ্ঞদের মতে, “দিনের পরিধি যত ছোট অথবা বড়ই হোক না কেন, আপনাদেরকে স্থানীয় সময় অনুসরণ করতে হবে।”   কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় ফিনল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের মাত্র কয়েক শ মুসলিম ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম মেনে চলেন। সিরিয়া থেকে আসা নাসের আহমাদী সৌদি আরবের মক্কা নগরের সময়ের সঙ্গে মিল রেখে রোজা রাখেন। তবে, তার ইবাদত কবুল হয় কি না, তা নিয়ে সংশয়ও আছে আহমাদীর। সিরিয়ায় যুদ্ধের কবল থেকে পালিয়ে লেবানন হয়ে তুরস্ক ও গ্রিস ঘুরে ফিনল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের শহর রোভানিয়েমী আসেন তিনি। মক্কার সময়ের সঙ্গে মিল রেখে রোজা রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ওইটাই ইসলামের জন্মভূমি। আমি ভুল করছি কি না, জানি না। কিন্তু আল্লাহর ঘরকে ঘিরে আমার ইবাদত তো কবুল হওয়ার কথা।” অবশ্য রোভানিয়েমী অউলু শহরের অনেকে মুসলিমই হাজার কিলোমিটার দূরে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকির স্থানীয় সময়ের সঙ্গে মিল রেখে সেহরি ও ইফতার করেন। হেলসিংকির সময় অনুসরণ করা সম্পর্কে তারা বলেন, “এটা নিকটবর্তী শহর, যেখানে রাত আর দিন আছে।” ইরিত্রিয়া থেকে আসা মুসলিম ইউসুফ আবদুল্লাহ এই ফতোয়া অনুসরণ করে হেলসিংকির সময় মেনে রোজা রাখেন। সেই হিসাবে রমজানে তার দীর্ঘতম রোজাটি হবে প্রায় ২০ ঘণ্টার। উত্তরাঞ্চলীয় শহরগুলোর মুসলমানদেরকে আরেক দল মুসলিম আছেন, যারা নামাজের স্থানীয় নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে মিল রেখেই রোজা রাখেন। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে আসা কানিজ ফাতিমা তাদের অন্যতম। সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে তাদেরকে সর্বোচ্চ ২৩ ঘণ্টাও রোজা রাখতে হবে। নিজের মতামত তুলে ধরে তারা বলেন, “আমরা রোভানিয়েমী থাকি। সারা বছর আমি এখানকার নির্ধারিত সময়ে নামাজ পড়ি। তাহলে রমজানের সময় আমি কেন হেলসিংকির সময় মেনে রোজা রাখব?” পাকিস্তান থেকে আসার পর থেকে গত চার বছরই ফাতিমা এই নিয়ম মেনে চলছেন। তুরস্কের মোহাম্মাদ ইব্রাহিম এখন গ্রীষ্মকালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সময়সূচি মেনে সেহরি ও ইফতার করেন। কেননা তুরস্কই সুইডেন থেকে সবচেয়ে কাছের মুসলিমপ্রধান দেশ। তবে, বিষয়টা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ইসলাম কঠোর নয়। আর রোজাও মানেও খালি উপোস থাকা বা নিজেকে কষ্ট দেয়া নয়। ফলে, মানুষের নিজের সুবিধামতো বেছে নেয়ার অধিকার আছে।” উতস্ইয়কির এবারের রমজান গ্রীষ্মকালে হলেও একসময় তা শীতকালে চলে যাবে। আর এখন সূর্য না ডোবার সমস্যার পরিবর্তে তখন সূর্য না ওঠার সমস্যায় পড়বেন এখানে বসবাসকারী মুসলিমরা। গ্রীষ্মকালে দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখার পরিবর্তে তখন মাত্র কয়েক ঘণ্টা রোজা রাখতে হবে তাদের। আবার শীতকালের কিছুদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়তে হবে মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যেই। কেননা বছরের ওই সময়ে মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্যই আকাশে সুর্যের গোধূলির ম্লান আলো দেখা যাবে। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফতোয়া অ্যান্ড রিসার্চের মহাসচিব হুসেইন হালাওয়া জানান, উত্তর মেরুঅঞ্চলের মুসলমানরা গ্রীষ্ম ও শীতকালে রোজা-নামাজ পালনের সংকট নিয়ে যদিও কোনো যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। তাই উতসইয়কির মতো এমন প্রতিকূল ভৌগোলিক অঞ্চলে নামাজ ও রোজার সময়সূচি নির্ধারণ করা নিয়ে তারা একটা সম্মেলন আয়োজনের চেষ্টা করছেন। হেলসিংকিস্থ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মসজিদের ব্যবস্থপনা পরিষদের অন্যতম সদস্য কামরুল আলম কমল ও জহুরুল ইসলাম সিকদারের মতে লম্বা দিন তাই রোযা থেকে বিরত থাকার ভালো কোনো অজুহাত নয়। তবে দিনে ২০-২২ ঘণ্টা রোযা রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এটা অর্জনে আমরা সক্ষম। হেলসিংকিতে বসবাসকারী প্রবাসী ব্যাবসায়ী মোহাম্মদ হান্নান ইসলাম বলেন, “রোজার মাসে ফিনল্যান্ডের যেসব অঞ্চলে সূর্য সম্পূর্ণভাবে অস্ত যায় না সেখানে রোজা পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ আলাদাভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি বিশেষের ওপর নির্ভর করে। ইসলাম এব্যাপারে অনেকগুলো বিকল্প সুযোগ রেখেছে।” এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মসজিদের ব্যবস্থপনা পরিষদের অন্যতম সদস্য লিমন চৌধূরী জানালেন, মাহে রমজানের এমাসে রাজধানী হেলসিংকিস্থ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মসজিদে পড়ানো হয় খতম-এ-তারাবি। তাছাড়া প্রতিদিনই মুসল্লিদের জন্য ইফতার ও সেহরীর বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজন্য মহিলাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে আলাদা কক্ষের। প্রতিদিন মহিলাসহ দেশীবিদেশী কয়েক'শ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি এই আয়োজনে অংশ নিয়ে থাকেন। সরকারি হিসেব মতে, ফিনল্যান্ডের মোট জনসংখ্যা ৫৫ লাখ। এদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ৬৫ হাজার।

No comments

Powered by Blogger.