চিকিৎসক থাকেন না, নানা ত্রুটি -২৩ হাসপাতাল নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শক দলের প্রতিবেদন by শেখ সাবিহা আলম

রাজধানীর তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী ভর্তির কোনো ব্যবস্থা নেই। বহির্বিভাগেও রোগীর সংখ্যা কম। তবে শল্যচিকিৎসক, স্ত্রী ও প্রসূতিরোগ বিশেষজ্ঞ, অবেদনবিদসহ ২৮ জন চিকিৎসক রয়েছেন। চিকিৎসক আছেন, তবে তাঁরা সময়মতো আসেন না, যন্ত্রপাতি-আসবাব আছে, কিন্তু সেগুলো বাক্সবন্দী, রোগনির্ণয়েও আছে গাফিলতি।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ১৮ জন কর্মকর্তা গত ছয় মাসে ২৩টি হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। পরিদর্শন শেষে তাঁরা যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন, সেখানেই পাওয়া গেছে তেজগাঁও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এসব তথ্য। তাঁরা দেখেছেন, কোনো হাসপাতালে বিনা অনুমতিতে চিকিৎসকেরা অনুপস্থিত, কোথাও চিকিৎসকেরা দেরিতে আসছেন, বেরিয়ে যাচ্ছেন তাড়াতাড়ি, কোথাও কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে স্বাক্ষর জাল করে ছুটির আবেদন করছেন, কোথাও হাজিরা খাতায় আগাম ও ভুয়া স্বাক্ষর করছেন। হাসপাতালগুলোয় অবকাঠামোগত সমস্যাও আছে। পথ্য সরবরাহের বেলায় রুই মাছের বদলে তেলাপিয়া মাছ দেওয়া এবং সবজিতে আলু বেশি দেওয়ার অভিযোগ করেছে পরিদর্শক দল।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার যে চিত্র, তা আশানুরূপ নয়। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, এই প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে এর মধ্যেই বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে চিকিৎসকদের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শুধু চিকিৎসক থাকলেই চলবে না, অন্যান্য ব্যবস্থাও উন্নত করা দরকার।
এদিকে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব এম ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘চিকিৎসকদের কোনো গাফিলতি নেই, সে কথা বলছি না। তবে চিকিৎসকদের কাছ থেকে মানুষ সেবাও পাচ্ছে। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি চিকিৎসকেরা কেনেন না, তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। শুধু ঢালাওভাবে চিকিৎসকদের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির প্রতি নজর না দিয়ে সবদিকে নজরদারি বাড়ানো দরকার।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত ৩০ অক্টোবর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক একটি সভায় হাসপাতালগুলোয় নজরদারি বাড়ানোর জন্য নির্দেশ দেন। এরপর ১৮ জন কর্মকর্তা হাসপাতালগুলোয় ১৯টি শর্ত মানা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখেন। এই শর্তগুলোর মধ্যে আছে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী ঠিক সময়ে হাসপাতালে হাজির থাকছেন কি না এবং নির্ধারিত সময় পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা দেন কি না, চিকিৎসকেরা নিয়মিত সকাল-সন্ধ্যা হাসপাতালে রোগী দেখেন কি না, হাসপাতাল থেকে দেওয়া পথ্য মানসম্মত কি না, হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধের সরবরাহ আছে কি না ইত্যাদি।
পরিদর্শক দল রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, ফরিদপুর, টঙ্গী, চট্টগ্রামের দোহাজারী, বান্দরবান সদর, রংপুরের মিঠাপুকুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও সরাইল, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া, ফরিদপুরের বক্ষব্যাধি, পিরোজপুরের নেছারাবাদ, সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খাগড়াছড়ির পানছড়ি, মহালছড়ি হাসপাতাল, রংপুরের তারাগঞ্জ, যশোরের টিবি ও জেনারেল হাসপাতাল, পটুয়াখালী ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী, কক্সবাজারের রামু ও মহেশখালী এবং সাতক্ষীরার কলারোয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শনে যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির পাশাপাশি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও তেজগাঁও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা ছিল প্রকট। টঙ্গী ৫০ শয্যা হাসপাতালে রোগীকে দাঁড় করিয়ে রেখে চিকিৎসকদের দীর্ঘ সময় গল্প করতে দেখা গেছে।
পরিদর্শক দল বেশির ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে মেশিন, অজ্ঞান করার মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন, ডেন্টাল চেয়ার ও অ্যাম্বুলেন্স অচল পেয়েছেন। সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৮ ধরনের যন্ত্রপাতি অচল। হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের ভেন্টিলেটর, অজ্ঞান করার মেশিন, সি-আর্ম মেশিন অব্যবহৃত পড়ে থেকে অচল হয়ে গেছে।
পরিদর্শক দল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় থাকা কর্মকর্তাদের প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি শুদ্ধাচার ও নৈতিকতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে।

No comments

Powered by Blogger.