কাঁদছে ময়মনসিংহ by মতিউল আলম

কাঁদছে ময়মনসিংহ। থামছে না স্বজনহারা মানুষের কান্না ও আহাজারি। প্রতিটি পরিবারে চলছে শোক আর মাতম। ক্ষোভে-দুঃখে অনেকে বলেছেন, গরিব হয়ে জন্ম নেয়াটাই দুঃখের। ঘটনাস্থলে একসঙ্গে এতগুলো লাশ মাটিতে পড়ে থাকার দৃশ্য ভুলতে পারছেন না ময়মনসিংহবাসী। গতকাল সরজমিন নিহতদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। পাটগুদাম ব্রিজসংলগ্ন বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আবদুল বারেক। তিনি শহরের একটি স’মিলে কাজ করেন। স্ত্রী শামীমা (৫৫), মেয়ে সখিনা (৩৫) ও নাতনি লামিয়াকে (৪) হারিয়ে এখন বাকরুদ্ধ তিনি। আবদুল বারেক জানান, তার স্ত্রী-কন্যারা কখনও জাকাতের জন্য বাইরে যায়নি। এই প্রথম জাকাত নিতে গিয়ে তারা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। প্রতিবারের মতো এবার মেয়ে-নাতনিকে নিয়ে তার ঈদ করা হলো না। একই ক্যাম্পের বাসিন্দা মৃত সুলতানের স্ত্রী হাজেরা খাতুন (৭০) ৪ সন্তানের জননী। দরিদ্রতার জন্য অতিকষ্টে দিন কাটতো তার। একটি নতুন কাপড়ের জন্য জর্দা ফ্যাক্টরিতে গিয়ে আর ফিরেননি। একেবারে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বৃদ্ধা মাকে হারিয়ে তার ছেলেমেয়েরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। হাজেরা খাতুনের ছেলেমেয়েরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের কষ্টের কথা কী বলবো- গরিব হয়ে জন্ম নেয়াটাই দুঃখের। এ ঘটনায় নিহত সেহড়া ধোপাখোলার মসজিদ রোডের বাসিন্দা জামেনা খাতুুন (৫৮)। তিনি জাকাতের কাপড়ের জন্য গিয়েছিলেন পরিবারের কাউকে না জানিয়ে। সকালে তার পরিবারের লোকজন খবর পায় জামেনা খাতুনের লাশ পড়ে আছে হাসপাতালে। জামেনা খাতুনের ছোট ছেলে সোহেল জানান, বাবার মৃত্যুর পর মা তাদের বাবা হারানোর ব্যথা কখনও বুঝতে দেননি। কিন্তু এখন তাদের অনুভব করতে হচ্ছে মা-বাবা দুটো হারানোর কষ্ট। শহরের সেহড়া ধোপাখোলা দত্তবাড়ির গরিব অসহায় সুধারানী সরকার (৫৭) শহরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে আয়ার কাজ করতেন। পরিবার তার ২ ছেলে ও ১ বিধবা মেয়ে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল মাকে হারিয়ে ছেলেমেয়েরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।
আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্সপড়ুয়া লাবণী থাকেন শহরের থানাঘাট বস্তিতে। তার মা খোদেজা আক্তার নতুন একটি কাপড়ের আশায় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু শুক্রবার সকালে ফিরেছেন লাশ হয়ে। স্বামীর মৃত্যুর পর খোদেজা আক্তার ছয় সদস্যের সংসারের ঘানি টানছিলেন অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করে। কাতর কণ্ঠে লাবণী বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর অন্যের বাড়িতে কাজ করে আমাদের লেখাপড়ার খরচ জোগাচ্ছিলেন মা। তার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষে যেন ভাল একটি চাকরি করি। কাঁদতে কাঁদতে লাবনী বলেন, এভাবে পদদলিত হয়ে মানুষের মৃত্যু বেদনাদায়ক। এখন কার জন্য পড়াশোনা করবো। আর সংসারই বা কীভাবে চলবে। সব স্বপ্নই যে এখন শেষ। ওদিকে থানাঘাট বেড়িবাঁধ বস্তির কৃষ্ণা মিয়া মেয়ের জন্য কেনা পায়ের নূপুর, ঝুমকা আর পুতুল হাতে নিয়ে নির্বাক কাঁদছিলেন। দুর্ঘটনায় তিনি হারিয়েছেন স্ত্রী সখিনা খাতুন, শিশুকন্যা লামিয়া ও শাশুড়ি শামু বেগমকে। পরিবারের তিন সদস্যের এমন করুণ মৃত্যুতে এখন শোকে পাথর কৃষ্ণা মিয়া। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, স্ত্রী সখিনা দুধের শিশুকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয় গভীর রাতে। একটি শাড়ির জন্য পায়ের নিচে চাপা পড়ে নিজেও মরলো, মেয়েটাকেও মারলো।
এদিকে নিহত পরিবারগুলো ১০ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান পেলেও আহতরা সরকারি কোন অনুদান পায়নি বলে জানা গেছে। অর্থ-সাহায্য না পাওয়ার কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে পারছে না তারা। গুরুতর আহত পাটগুদাম ব্রিজসংলগ্ন বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা আসমা (৫০) ও তার ছেলে রাজ (২১) জানান, জাকাতের কাপড় আনতে তারাও ভোরে নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিল। রাজের মা নিচে পড়ে গেলে তাকে বাঁচাতে গিয়ে রাজও গুরুতর আহত হয়। কিন্তু অর্থের অভাবে চিকিৎসাসেবা না নিয়েই তাদের বাসায় ফিরতে হয়েছে। ১৩ সদস্যের অভাবী পরিবারে এখন তারা যুক্ত হয়েছেন নতুন বোঝা হিসেবে। ক্ষতিগ্রস্ত এ পরিবারগুলোর পুনর্বাসনে সরকার বা সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসবে- এমনটাই প্রত্যাশা স্বজনহারা হতদরিদ্রদের।
উল্লেখ্য, শুক্রবার ভোরে ময়মনসিংহ জেলা শহরের অতুল চক্রবর্তী রোডের নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরি থেকে জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে ২৭ জনের মৃত্যু ও অন্তত ২০ জন আহত হন। এ ঘটনায় ফ্যাক্টরি মালিক ও তার ছেলেসহ আটজনকে আটক করে পুলিশ। এদিকে শুক্রবার রাতেই নিহতদের দাফন-কাফন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
ওদিকে ময়মনসিংহে জাকাত ট্র্যাজেডির ২৭ জন নিহতের ঘটনার নূরানি জর্দ্দা ফ্যাক্টরির মালিক মোহাম্মদ শামীম ও তার ছেলেসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য কোতোয়ালী থানার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই সাইদুল ইসলামকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মুসফিকুর রহমান শামীমসহ এই ঘটনায় জড়িত ৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য  ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে গতকাল সকালে ময়মনসিংহ ১নং আমলী আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল  ম্যাজিস্টেট আহসান হাবিবের আদালতে হাজির করলে আদালত রিমান্ডের শুনানির জন্য  আজ রোববার  দিনধার্য করেছেন।
এদিকে নূরানি জর্দ্দা ফ্যাক্টরির মালিক শামীম তালুকদারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ফুঁসে উঠছে ময়মনসিংহ। এই মর্মান্তিক ঘটনার শোকে স্তব্ধ ময়মনসিংহবাসী। শহরের প্রত্যেক সচেতন মানুষের কণ্ঠে একই আওয়াজ শামীমসহ সংশ্লিষ্টদের উপযুক্ত বিচার হোক। এই দাবিতে ময়মনসিংহে চলছে শহরে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন। ময়মনসিংহে পদদলিত হয়ে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে গতকাল মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ময়মনসিংহ জেলা টিইউসি, জেলা যুব ইউনিয়ন ও ছাত্র ইউনিয়ন। গতকাল দুপুরে শহরের গাঙ্গিনারপাড় শহীদ-ফিরোজ জাহাঙ্গীর চত্বরে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচিতে জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. এমদাদুল হক মিল্লাত, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফেরদৌস আরা মাহমুদা হেলন, সাধারণ সম্পাদক মনিরা বেগম অনু, যুব ইউনিয়নের সভাপতি আবদুর রব মোশাররফ প্রমুখ অংশ নেন। এদিকে একই দাবিতে একই স্থানে সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ পৃথকভাবে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।
জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ২৭ জন নিহতের ঘটনায় নূরানি জর্দ্দা ফ্যাক্টরির মালিক মোহাম্মদ শামীম ও তার ছেলেসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে শুক্রবার সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম জানান, মামলার আসামিরা হলেন- নূরানি জর্দ্দা ফ্যাক্টরির মালিক মোহাম্মদ শামীম (৬৫) ও তার ছেলে হেদায়েত তালুকদার (৩০), ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ইকবাল হোসেন (৩৫), ইকবাল (৪০), আরমান হোসেন (৩৫), আলমগীর হোসেন (৩৪), আরশাদুল ইসলাম (৩২), ড্রাইভার পারভেজ (৩৫) ও কর্মচারী আ. হামিদ (৩৬)। আসামিরা সবাই পুলিশের হাতে আটক রয়েছে।
শুক্রবার ভোরে ময়মনসিংহ জেলা শহরের অতুল চক্রবর্তী রোডের নূরানি জর্দ্দা ফ্যাক্টরি থেকে জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরও অন্তত ২০ জন। এ ঘটনায় ফ্যাক্টরি মালিক ও তার ছেলেসহ আটজনকে আটক করে পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.