আশরাফকে সরাতে দলের একটি অংশ তৎপর ছিল

মন্ত্রী হই বা না হই, রাজনীতি করি বা না করি, হোসেনপুরবাসীর সঙ্গে থাকব মন্ত্রণালয়ে নিষ্ক্রিয়তার জন্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করার কথা আলোচনায় থাকলেও কার্যত দীর্ঘদিন ধরেই দলের একটা অংশ তাঁকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সারির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া যায়। তবে এখন আওয়ামী লীগের ভেতরে কিছুটা থমথমে পরিস্থিতি থাকায় কেউ উদ্ধৃত হয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
সৈয়দ আশরাফকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় রাজনীতিতে তাঁর থাকা না-থাকা নিয়েও দল এবং বিভিন্ন পর্যায়ে নানা আলোচনা আছে। এ অবস্থার মধ্যে গতকাল শনিবার রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে ঢাকাস্থ হোসেনপুর সমিতির ইফতার মাহফিলে সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘আমি লাভের জন্য রাজনীতি করি না। আমার পিতা সততার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। নেতার জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন। এটাই আমার রক্ত।’
হোসেনপুরবাসীর উদ্দেশে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী আশরাফ আরও বলেন, ‘আমার পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করেননি। মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি মন্ত্রী হই বা না হই, রাজনীতি করি বা না করি, সব সময় হোসেনপুরবাসীর সঙ্গে থাকব।’
ইফতারের প্রায় ১৫ মিনিট আগে বক্তব্য দেওয়ার জন্য মাইক হাতে নিলেও দুই মিনিট বক্তব্য দিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করতে চান। তখন উপস্থিত এলাকাবাসী বলতে থাকেন, নেতা আরও বলেন। তারপরও তিনি আর বক্তব্য দেননি।
ওই অনুষ্ঠানে বক্তারা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তাঁরা বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তে কিশোরগঞ্জ ও হোসেনপুরবাসী ক্ষুব্ধ। তবে আমরা নেতার সঙ্গে আছি এবং থাকব।
নুরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব শাহ মো. মনসুরুল হক, মো. আবদুস ছাত্তার, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ারুল কবীর।
এদিকে আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক-এগারোর পর মহাজোট সরকার গঠন এবং আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির ঘটনায় দলের প্রভাবশালী কেউ কেউ সৈয়দ আশরাফের ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। আবার সৈয়দ আশরাফের সমসাময়িক নেতাদের কেউ কেউ তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিতও ছিলেন। দলের এই প্রভাবশালী নেতারা যুগপৎভাবেই তাঁর পেছনে লেগে থাকতেন।
আবার সৈয়দ আশরাফের নির্লিপ্ততা তাঁর বিরোধী অংশকে আরও সুযোগ করে দেয়। দল ও সরকারে দীর্ঘদিন ধরে এ পরিস্থিতি থাকায় দলীয় সভানেত্রীর সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যে কারণে তাঁকে দপ্তরবিহীন হতে হয়েছে বলে দলের অনেকে অনুমান করেন। সৈয়দ আশরাফের দপ্তর কেড়ে নেওয়ার পর তাঁর বিরোধী অংশ এখন অনেক ফুরফুরে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সৈয়দ আশরাফকে সরাতে দলীয় সভানেত্রীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টির জন্য দলের ওই অংশটি দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টায় ছিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশরাফ একজন সৎ রাজনীতিক। এ ঘটনায় তিনি কোনো বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেননি।
শুধু একটি বৈঠকে অনুপস্থিত থাকার জন্য দলের সাধারণ সম্পাদককে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেন না দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও স্বীকার করেছেন, সৈয়দ আশরাফকে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অনেক আগের।
দপ্তরবিহীন হওয়ার দুই ঘণ্টা পর যুবলীগের এক অনুষ্ঠানে তিনি স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। গত দুদিনে তাঁর বাসভবনে আসা দলীয় নেতা-কর্মী ও শুভার্থীদের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। গত দুদিনে বাসভবনে গিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যসহ কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। গতকাল আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের কর্মচারীরাও তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় সবার সঙ্গে বেশ হাসিখুশি মেজাজে কথা বলেন তিনি।
এদিকে দলের কয়েকজন নেতা জানান, দলের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কী বোঝাপড়া হয়েছে, তা তাঁরা অনুমান করতে পারছেন না। তবে প্রধানমন্ত্রী ও আশরাফের সম্পর্ক অনেক গভীর ও বিশ্বস্ততার—এটা সবাই স্বীকার করছেন। গত দুদিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং লন্ডনে অবস্থানরত তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা একাধিকবার সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া কোনো কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন কূটনীতিক তাঁর বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন বলে জানা গেছে।
আজ রোববার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নবনিযুক্ত মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বেইলি রোডের বাসভবনে সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। ১৫ জুলাই সৈয়দ আশরাফ ১৫ দিনের জন্য লন্ডন যাবেন। সেখানে তাঁর স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে ঈদ করবেন। এ ছাড়া তাঁর ছোট ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানেও যোগ দেবেন তিনি।
আপডেট: জুন ০৮, ২০১৪ -প্রথম আলো
আ.লীগের জন্য কেউ অপরিহার্য নয়: সৈয়দ আশরাফ
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, আওয়ামী লীগ একটি বিরাট সংগঠন, এখানে যোগ্য লোকের অভাব নেই। দলের জন্য কেউ অপরিহার্য নয়। দলের মধ্যে যদি শৃঙ্খলা না থাকে, তা হলে সাংগঠনিক ভিত কখনো মজবুত হবে না।
আজ রোববার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে সৈয়দ আশরাফ এমন মন্তব্য করেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি ছিল রুদ্ধদ্বার। এতে দলটির সব যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদকেরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের অন্তত পাঁচজন নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সংগঠনকে মজবুত করতে ধীরে ধীরে অন্যান্য সাংগঠনিক জেলাগুলোর কাউন্সিলের তারিখ চূড়ান্ত করা হবে বলে বৈঠকে সৈয়দ আশরাফ জানিয়েছেন। তবে তিনি নারায়ণগঞ্জ কিংবা ফেনীর সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে কোনো কথা বলেননি।
বৈঠকে একজন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রস্তাব করেন, সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হলে বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা করতে হবে। বৈঠকে উপস্থিত সবাই এটি সমর্থন করেন।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা চীন থেকে দেশে ফেরার পর যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
আজকের বৈঠকে সাত সাংগঠনিক জেলার কাউন্সিলের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা হয়। ২১ জুন মুন্সিগঞ্জে, ২৬ জুন বরগুনায়, ২৭ জুন পটুয়াখালীতে, ২৮ জুন কিশোরগঞ্জে, ১২ জুলাই ঠাকুরগাঁওয়ে, ১৫ জুলাই খুলনা মহানগরে এবং ১৯ জুলাই রাজশাহী মহানগরে কাউন্সিল করার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে তারিখগুলো চূড়ান্ত করা হবে।
কাউন্সিলে শামীম ওসমান ও নিজাম হাজারীর মতো ‘বিতর্কিতরা’ স্থান পাবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘আমরা চাই কাউন্সিলরা সত্, যোগ্য ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিতদের নেতা নির্বাচন করবে। বিতর্কিতদের তাঁরা বর্জন করবেন।’
‘বৈধ পথে শেখ হাসিনার পতন ঘটানো যাবে না’—সৈয়দ আশরাফের এমন বক্তব্যের ব্যাখ্যায় হানিফ বলেন, ‘এর অর্থ হচ্ছে শেখ হাসিনা যে উন্নয়ন করছেন তাতে দেশ ও মানুষ উপকৃত হচ্ছে। মানুষ তাঁকে চায়। এ জনপ্রিয়তার কারণে তাঁকে বৈধ পথে হটানো যাবে না। আশরাফ সাহেব এটাই বোঝাতে চেয়েছেন।’

No comments

Powered by Blogger.