ভেসে গেছে মাছ, ডুবেছে বীজতলা

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে কক্সবাজারের পেকুয়া
উপজেলার ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ছবিটি পেকুয়া সদর
ইউনিয়নের বলিরপাড়া গ্রাম থেকে তোলা l প্রথম আলো
টানা বর্ষণে হাঁটুপানিতে তলিয়ে গেছে নোয়াখালী ও ফেনী শহরের বিভিন্ন সড়ক। কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আমন ধানের বীজতলা ডুবে গেছে। পানিতে ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। বেড়িবাঁধ ভেঙেছে ফেনীর ফুলগাজী ও কক্সবাজারের চকরিয়ায়।
ঢাকার বাইরে প্রথম আলোর আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
চকরিয়া ও পেকুয়া: গতকাল শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের মেহেরনামা এলাকায় বেড়িবাঁধের দুটি ভাঙা অংশ দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকছে।
পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ বলেন, উপজেলার অন্তত ৪০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। পানিতে তলিয়ে গেছে অনেক কৃষকের আমনের বীজতলা।
পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মারুফুর রশিদ খান জানান, দুর্গত মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলার বমুবিলছড়ি, মানিকপুর-সুরাজপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, চিরিংগা, কৈয়ারবিল, বরইতলী, শাহারবিল, পূর্ব বড়ভেওলা, বিএমচর, কোনাখালী ও হারবাং ইউনিয়নেও বন্যা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ৩০ জুনের বন্যায় ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কার না করায় লোকালয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম জানান, পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানির তোড়ে চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগর ঘোনায় আবারও বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে ওই ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তিনি জানান, চকরিয়া উপজেলার অন্তত ৭৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, চকরিয়ার সওদাগর ঘোনা এলাকার ভাঙা বেড়িবাঁধের সংস্কারকাজ তিন দিন আগে শেষ হয়েছে। মাটি কাঁচা থেকে যাওয়ায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে শনিবার দুপুরে সেটি ভেঙে গেছে। এ ছাড়া পেকুয়ার মেহেরনামা বেড়িবাঁধের জন্য তিন-চার দিন আগে বরাদ্দ পাওয়া গেছে। শনিবার সকাল থেকে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বন্যা শুরু হয়ে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। বৃষ্টি কমলে ভাঙা বেড়িবাঁধের সংস্কারকাজ শুরু করা হবে।
সাতকানিয়া: টানা নয় দিনের বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা, বাজালিয়া, সোনাকানিয়া, আমিলাইশ, চরতি ও কেঁওচিয়া ইউনিয়নের ৩৫টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিতে ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ।
গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকায় শাকসবজির খেত ও আমন বীজতলা ডুবে আছে। তলিয়ে গেছে সাতকানিয়া-বাঁশখালী সড়ক, রামপুর ডিসি সড়ক, ছিদ্দিকিয়া মহিলা মাদ্রাসা সড়ক ও হাতিয়ারকুল সড়ক।
ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোশাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেকের বসতঘরে পানি ঢুকে পড়েছে।
সাতকানিয়ার ইউএনও মোহাম্মদ উল্যাহ বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে। তালিকা পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফেনী: টানা বর্ষণে ফেনী শহরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক প্রায় তিন ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া শহরের একাডেমী এলাকা থেকে সদর হাসপাতাল পর্যন্ত সড়ক, শান্তি কোম্পানি সড়ক, নাজির রোড, পেট্রোবাংলা সড়কসহ বিভিন্ন পাড়ামহল্লার সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। ডাক্তারপাড়া, শান্তি কোম্পানি রোড, মিজানপাড়া, বাঁশপাড়া, একাডেমী এলাকা, শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কের শত শত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসায় পানি ঢুকেছে।
শহরের অনেক বাসিন্দার অভিযোগ, সময়মতো নর্দমা পরিষ্কার না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে ফেনী পৌরসভার প্যানেল মেয়র মোসলে উদ্দিন হাজারী এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ফেনীর ফুলগাজীতে মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের দুটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। তলিয়ে গেছে আমন ধানের বীজতলা। দুই ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক মহাসড়কের ফুলগাজী বাজার অংশ। পানি ঢুকে পড়েছে ফুলগাজী বাজারের কয়েক শ দোকানে। পানির তোড়ে ফুলগাজীর দৌলতপুর গ্রামের দুটি কাঁচা বসতঘর ভেঙে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী রমজান আলী প্রামাণিক জানান, শনিবার সকালে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও দুপুরের পর তা ৬০ সেন্টিমিটারে নেমে আসে।
ফেনীতে গত শুক্রবার সকাল ছয়টা থেকে গতকাল সকাল ছয়টা পর্যন্ত ১৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার রাত ১২টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৩২ মিলিমিটার।
নোয়াখালী: গতকাল সকালে জেলা শহরের মাইজদী কোর্ট স্টেশন, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, সার্কিট হাউস সড়ক, জেলা জামে মসজিদ সড়ক, কাজী কলোনি, হরিনারায়ণপুর ও পৌর বাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ সড়কেই প্রায় হাঁটুপানি। বৃষ্টির পানির সঙ্গে সড়কের পাশের নর্দমার ময়লা পানি মিশে একাকার হয়ে গেছে।
পৌর মেয়র হারুনুর রশিদ আজাদ বলেন, পানিনিষ্কাশনে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পৌরসভার কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে অতিবৃষ্টিতে সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া, অর্জুনতলা, কেশারপাড়, ডমুরুয়া ও কাদরা ইউনিয়নের নিচু এলাকার অনেক রাস্তাঘাট ডুবে গেছে।
সেনবাগ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন জানান, রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় এবং আঙিনায় পানি ওঠায় উপজেলার বাতাকান্দি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় ও এনায়েতপুর আলিম মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক প্রণব ভট্টাচার্য বলেন, বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৪০০ হেক্টর আমন বীজতলা পানিতে ডুবে গেছে।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছে, ফেনী ও নোয়াখালী অফিস, সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) ও চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি}

No comments

Powered by Blogger.