গায়েবি আপসনামা by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

‘গায়েবি’ আপসনামায় মামলা নিষ্পত্তির পথ তৈরি করে দিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। অথচ এর কিছুই জানা নেই মামলার বাদী সিলেট শহরতলির কুশিঘাটের বাসিন্দা জুবের আহমদের। প্রাণে মারার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগে তিনি ছাত্রদলের জনা চল্লিশেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। আদালতে বিচার শুরুর আগেই পুলিশ তাদের বাঁচিয়ে দিতে চাইছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে শেষের দিকে মন্তব্যেই মামলার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছেন তিনি। ‘মামলার বাদী আপসনামা দাখিল করত: জানান যে, তিনি আর মামলা চালাইবেন না এবং আর কোন সাক্ষী-প্রমাণ হাজির করা সম্ভব নহে।’ ছাত্রদল নেতা জিল্লুল হক জিল্লু হত্যার প্রতিবাদে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন কর্মসূচি শেষে ফেরার পথে ২০১৪ সালের ১৬ই জুলাই নগরী মিরবক্সটুলায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন সিলেট শহরতলির কুশিঘাটের বাসিন্দা ও সিলেট এমসি কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছাত্রদল নেতা জুবের আহমদ। হামলাকারীরা প্রথমে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তার মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। পরে তাকে রাস্তায় ফেলে কোপাতে থাকে এবং তার বুকে ও পিঠে ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন ছাত্রদল নেতা জিয়াউল গণি আরেফিন জিল্লুর, অমর আশরাফ ইমন, সৈয়দ সাফেক মাহবুব, মাহবুব কাদির শাহী, জামাল আহমদ উরফে কালো জামাল, কাজী মেরাজসহ ২৬ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১০/১৫ জনকে আসামি করে কোতোয়ালি মডেল থানায় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলা (নং: ১৫) করেন। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই মো. মাসুদুর রহমান। তদন্তকালে তিনি মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও সন্ধিগ্ধ আসামি হিসেবে জনৈক বেলাল আহমদকে গ্রেপ্তার করেন। ওই কর্মকর্তা মামলার বাদী জুবের আহমদ, সাক্ষী মঞ্জু দাস, আবুল বাশার ও মো. শাওনের ১৬১ ধারায় জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। এ মামলার আসামিদের নাম ঠিকানা যাচাই করতে বিভিন্ন থানায় অনুসন্ধান স্লিপও পাঠান। পাশাপাশি অন্য মামলায় কারাগারে আটক থাকা ছাত্রদল নেতা আলী আকবর রাজন, সাব্বির আহমদ সুমনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তিন দিনের রিমান্ড আবেদনও করেন। তবে হঠাৎই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে মামলাটি তদেন্তর দায়িত্ব পড়ে এসআই মুহাম্মদ বোরহান উদ্দিনের কাঁধে। আর তখন থেকেই মামলাটির বাঁক বদলের শুরু। প্রথম অবস্থায় মামলাটি যে পথে এগুচ্ছিল নতুন তদন্ত কর্মকর্তা দায়িত্ব নেয়ার পর তা ঘুরে যায় একেবারে উল্টো দিকে। তখন থেকেই মামলার বিষয়ে অন্ধকারে রাখা হতে থাকে মামলার বাদীকে। পুলিশের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ করা হয়নি। মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান ২০১৪ সালের ১৭ই জুলাই ১৬১ ধারায় মামলার সাক্ষী মঞ্জু দাস, আবুল বাশার ও মো. শাওনের যে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন তাতে তারা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবেই সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। এ তিন সাক্ষীর একজন আশপাশের দোকান মালিক ও দুজন কর্মচারী। জবানবন্দিতে তারা উল্লেখ করেন, ঘটনার সময় তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তারা হামলাকারীদের নামোল্লেখ করে শনাক্তও করেন। অথচ মামলার পরবর্তী তদন্ত কর্মকর্তা এসআই বোরহান উদ্দিন চলতি বছরের ২৫শে ফেব্রুয়ারি আবার যখন এ তিনজনের বক্তব্য রেকর্ড করেন, তাতে ঘটনা প্রত্যক্ষের কোন বর্ণনা নেই। এ তিনজনের পাশাপাশি এসআই মুহাম্মদ বোরহান উদ্দিন নতুন আরও দুজন সাক্ষীর জবানবন্দি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। মো. নূরুল ইসলাম ও মো. আসাদ নামের এ দুই সাক্ষী ঘটনার সময় ছিলেন না, পরে ঘটনাস্থলে গেছেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা বুরহান উদ্দিন স্পষ্টই ঘোষণা দেন, ‘মামলার তদন্তকালে কে বা কাহারা বাদীকে জখম করিয়াছে সেই বিষয়ে কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পাওয়া যায় নাই।’ অবশ্য ঘটনা যে ঘটেছে তা তিনি নিশ্চিত হতে পেরেছেন। মামলার অভিযুক্তদের বাঁচানোর চূড়ান্ত প্রয়াস দেখা যায় চূড়ান্ত প্রতিবেদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে। তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘ছাত্রদল ও যুবদলের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ের কারণে মামলার ঘটনায় পক্ষ বিপক্ষ সৃষ্টি হইলেও পরে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ পরস্পরের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি আপস-মীমাংসা করিয়া দিয়াছেন জানাইয়া মামলার বাদী আপসনামা দাখিল করত: জানান যে, তিনি আর মামলা চালাইবেন না এবং আর কোন সাক্ষী-প্রমাণ হাজির করা সম্ভব নহে।’
তদন্ত কর্মকর্তা আপসনামার উল্লেখ করলেও মামলার বাদী এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। মামলার বাদী জুবের আহমদ কোন আপসনামা দেননি জানিয়ে মানবজমিনকে বলেন, যারা আমাকে প্রাণে মারার লক্ষ্যে হামলা চালিয়েছে তাদের সঙ্গে  আপসরফার তো প্রশ্নই আসে না। মামলার বিষয়ে তাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে উল্লেখ করে জুবের আহমদ বলেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এমনকি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও যে পরিবর্তন হয়েছে তাও তাকে জানানো হয়নি। মামলার বাদী জুবের আহমদ ও তার আইনজীবী ফখরুল ইসলাম মানবজমিনকে নিশ্চিত করেন, তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক দাখিলকৃত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তারা ২৭শে জুলাই মামলার পরবর্তী ধার্য্য তারিখে আদালতে নারাজির আবেদন দাখিল করবেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মুহাম্মদ বোরহান উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সরকার পক্ষের কৌশলীর মৌখিক অভিমত নেয়া হয়েছে। কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহেল আহমদ ও সহকারী কমিশনার একেএম সাজ্জাদুল আলম চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি আদালতের উদ্দেশ্যে অগ্রবর্তী করেছেন। আপসনামা প্রসঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, বাদীই তাকে আপসনামাটি দিয়েছেন এখন অস্বীকার করলে কিছু করার নেই। আদালতে যদি আপসনামাটি জাল প্রমাণ হয়, তখন কি হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে এসআই মুহাম্মদ বোরহান উদ্দিন বলেন, আদালত বিষয়টি দেখবে।

No comments

Powered by Blogger.