স্বাধীনতার চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে by কুলদীপ নায়ার

সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার
বিস্ময়কর হলেও ব্যাপারটা সত্য যে ইন্দিরা গান্ধী ভারতে যে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, তার বিরোধিতা করেছিল তখনকার জনসংঘ যা এখন বিজেপি এবং শিখদের আকালি দলের মতো সংকীর্ণমনা রাজনৈতিক শক্তিগুলো। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিসহ ধর্মনিরপেক্ষ অন্য দলগুলো বিনা প্রতিবাদে ইন্দিরা গান্ধীর কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন মেনে নিয়েছিল। মার্ক্সবাদীরা এতে অখুশি হলেও নিশ্চুপ ছিল।
মনে হতে পারে, ৪০ বছর অনেক লম্বা সময়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর ভারতে যে জঙ্গলের রাজ কায়েম হয়েছিল, সেই স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য ৪০ বছর অত দীর্ঘ সময় নয়। বর্তমান কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনের সময় সরকারি সুবিধা ব্যবহার করার কারণে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন। তখন তাঁর পদত্যাগ করা উচিত ছিল। আবার সর্বোচ্চ আদালতের অবকাশকালীন বিচারক সে রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে রেহাই দিয়েছিলেন।
তারপরও ইন্দিরা গান্ধী চূড়ান্ত ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। আবার রায়ের পর নাকি এমন একটা সময় ছিল, যখন তিনি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের জন্য পদত্যাগ করে জগজ্জীবন রাম বা তৎকালীন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমলাপতি ত্রিপাঠিকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁর ছেলে সঞ্জয় গান্ধী, যিনি পরবর্তীকালে সংবিধানবহির্ভূতভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, এমনকি সরকারও চালিয়েছেন, তিনি তাঁর মায়ের দুর্বলতা সম্পর্কে জানতেন। তিনি তখন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বংশী লালের সহায়তায় একদল লোক ভাড়া করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে তাদের দিয়ে মিছিল করিয়েছিলেন। এতে ইন্দিরার মধ্যে প্রকৃত অর্থেই এই প্রত্যয় সৃষ্টি হয় যে মানুষ তাঁকে চায়, শুধু রাজনীতিকদের একটি অসন্তুষ্ট অংশ তাঁর বিরুদ্ধে। তারপর থেকে ইন্দিরা সঞ্জয়ের ওপর চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনের সূত্রে জানা যায়, তিনি সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে একান্তে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন। সে সময় তিনি রাজীব গান্ধীকে উপেক্ষা করতেন। তিনি ভাবতেন, রাজীব রাজনীতিবিমুখ। আবার এটাও সত্য, রাজনীতিতে রাজীবের আগ্রহ খুব কমই ছিল। তিনি বিমান চালনায় উৎকর্ষ অর্জন করেছিলেন। রাজীব তখন ভারতের একমাত্র অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল কোম্পানি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের সবচেয়ে দক্ষ পাইলট। এটা একটা ভিন্ন বিষয় যে ইন্দিরা গান্ধী রাজীবের ওপর রাজনীতি চাপিয়ে দেন আর রাজীব, তার বদলে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্ব চাপিয়ে দেন জনগণের ওপর।
তখন গণমাধ্যমের ভূমিকাও ছিল খুব করুণ (তখন ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম ছিল না)। তারা শৌর্য ও মূল্যবোধের প্রচারণা চালিয়েছে, কিন্তু খুব কম পত্রিকা ও মানুষই ইন্দিরার জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করেছে। ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘একটি কুকুরও ঘেউ ঘেউ করেনি।’ এ কথার মধ্যে এক রকম কর্তৃত্বের সুর ছিল। তথাপি, এটা তো সত্য যে গণমাধ্যম তখন মাথা নত করে ছিল।
সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাঁর সহকর্মীদের প্রায়ই উপদেশ দিতেন, গদিতে বসলে হালকাভাবে বসুন, শিকড় গেড়ে নয়। সে কারণে রেলমন্ত্রী থাকার সময় তামিলনাড়ুতে বড় এক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় নিয়ে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন তাঁর মন্তব্যের হুলে বিদ্ধ হয়ে আমি ১০৩ জন সাংবাদিককে (সেই তালিকা এখনো আমার কাছে আছে) প্রেসক্লাবে জড়ো করতে পেরেছিলাম। এর জন্য আমাকে বিভিন্ন পত্রিকার কার্যালয়ে যেতে হয়েছে, দুটি সংবাদ সংস্থার কার্যালয়েও যেতে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন টাইমস অব ইন্ডিয়ার আবাসিক সম্পাদক গিরিলাল জৈন। জরুরি অবস্থা ও সেন্সরশিপ আরোপের সমালোচনা করে আমি যে প্রস্তাবের খসড়া প্রণয়ন করেছিলাম, সেটা তাঁদের পড়ে শোনাই। একজন সাংবাদিক বললেন, কয়েকজন সম্পাদককে আটক করা হয়েছে। আমি উপস্থিত সাংবাদিকদের ওই খসড়ায় স্বাক্ষর করার আহ্বান জানাই। আমি বললাম, আমার স্বাক্ষরে সেটি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও তথ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠাব।
প্রেসক্লাব ত্যাগ করার আগে আমি প্রস্তাবের কপিটা পকেটে ভরি, পাছে পুলিশ সেটা হস্তগত করে। বাসায় পৌঁছার পরপরই তথ্যমন্ত্রী ভি সি শুক্লা ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, আমি তাঁর কার্যালয়ে যেতে পারব কি না। শুক্লা তখন পর্যন্ত আমার বন্ধুই ছিলেন। কিন্তু শুক্লার বাসায় গিয়ে আমি এক ভিন্ন মানুষকে আবিষ্কার করি। তাঁর কথায় ছিল কর্তৃত্বের সুর, ভাবে–ভঙ্গিতে তিনি আমাকে হুমকিই দিলেন। তিনি আমাকে সাংবাদিকদের স্বাক্ষর করা কাগজটি তাঁকে দিতে বলেন। আমি ‘না’ বললে তিনি আমাকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে ভয় দেখান। তিনি বলেন, ‘আপনাকে বুঝতে হবে, এটা এক ভিন্ন সরকার। এই সরকারের হোতা হচ্ছেন সঞ্জয় গান্ধী। এটা ইন্দিরা গান্ধীর সরকার নয়।’
তারপরও আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বলি, ‘...ম্যাডাম, কখন কী প্রকাশ করা উচিত তা একজন সাংবাদিকের পক্ষে নির্ধারণ করা সব সময়ই কঠিন...একটি মুক্ত সমাজে, জরুরি অবস্থার পর আপনি বলেছিলেন, মুক্ত সমাজের ধারণায় আপনি বিশ্বাসী, সংবাদপত্রের দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষকে তথ্য দেওয়া। কখনো কখনো এটি তেমন সুখকর কাজ নয়, কিন্তু এটা করতে হবে। কারণ, তথ্যের অবাধ প্রবাহের ওপরই মুক্ত সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে। গণমাধ্যম এখন যেমন সরকারের তথ্য বিবরণী ও সরকারি বিবৃতি প্রচার করছে, সেটাই যদি তার কাজ হয়, তাহলে সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি, ঘাটতি—এসব দেখাবে কারা?...’
তিন মাস জেল খাটার পর আবার সবকিছু শুরু করার চেষ্টা করলে আমি হতাশার সঙ্গে দেখলাম, সাংবাদিকেরা ভয় পেয়ে গেছেন, তঁারা আমাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করতে চান না। তৎকালীন জনসংঘের নেতা এল কে আদভানি ঠিকই বলেছিলেন, ‘আপনাদের সাংবাদিকদের মাথা নিচু করতে বলা হলেও আপনারা হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করেছিলেন।’
আজকের প্রজন্মের কাছে জরুরি অবস্থার সময়ের ইতিহাস জানাতে হলে পুরোনো একটি কথাই আবার বলব, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। ৭০ বছর আগে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সময় যেমন এটা সত্য ছিল, তেমনি সেটা আজ আরও বেশি সত্য। উচ্চ আদালত অভিযুক্ত করার পর একজন প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে না গিয়ে সংবিধান স্থগিত করবেন, এটা কেউ কোনো দিন ভাবতে পারেনি।
সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাঁর সহকর্মীদের প্রায়ই উপদেশ দিতেন: গদিতে বসলে হালকাভাবে বসুন, শিকড় গেড়ে নয়। সে কারণে রেলমন্ত্রী থাকার সময় তামিলনাড়ুতে বড় এক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় নিয়ে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি ঘটনার নৈতিক দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
আজ সেই নজির কেউ অনুসরণ করবে, এটা চিন্তা করাও কঠিন। কিন্তু দুনিয়া এখনো মনে করে, ভারতে মূল্যবোধের কদর আছে। মহাত্মা গান্ধী জাতিকে যা বলেছিলেন, আজ আমাদের সেখানে ফেরত যেতে হবে: বৈষম্যের কারণে জাতি মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এই যে স্বাধীনতাসংগ্রামের সেই দিনগুলো স্মরণ করছি, তার কারণ আছে। সবাই তখন হাতে হাত রেখে ব্রিটিশদের তাড়িয়েছিল। আমি আশা করি, সেই চেতনা পুনর্জীবিত করে আমরা দারিদ্র্য দূর করব। তা না হলে স্বাধীনতা শুধু সম্পদশালীদেরই উন্নত জীবন দেবে, বাকিদের নয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.