মোবাইল কোর্টে জরিমানার অর্থ গায়েব হচ্ছে by দীন ইসলাম

মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আরোপিত জরিমানার আদায় করা অর্থ গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এসব অর্থ আত্মসাতে জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দেশের কয়েকটি জেলা প্রশাসন দণ্ডের অর্থ গায়েবের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছে। জেলা প্রশাসনগুলোর এ-সংক্রান্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আদায়কৃত দণ্ডের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমাদান নিশ্চিত করা ও আত্মসাৎ ঠেকাতে গত ৮ই জুলাই একটি পরিপত্র জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি পরিবীক্ষণ অধিশাখা। পরিপত্রে বলা হয়েছে, মোবাইল কোর্ট কর্তৃক আরোপিত দণ্ডের আদায় করা অর্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মামলার নথি, জরিমানা আদায় রেজিস্ট্রার, চালানের কপি ইত্যাদি কাগজপত্র মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ করবেন। সরকারি কোষাগারে জমাকৃত অর্থের ক্যাশ ট্রানজিকশন রিপোর্ট (সিটিআর) প্রতি মাসে সংগ্রহ করতে হবে এবং জমাকৃত অর্থের হিসাবের সঙ্গে সিটিআর যাচাই করে নিতে হবে। এরই মধ্যে পরিপত্রটি সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের কাছে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা মানবজমিনকে বলেন, মাঠ প্রশাসনের সবাইকে সতর্ক করতেই বিভিন্ন খাতে আদায় করা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করা হয়েছে। স্টাফ লেভেলে সরকারি অর্থ জমা দিতে দেরি করে। তাদেরকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যই মূলত এটা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মোবাইল কোর্টের জরিমানার দণ্ড হিসেবে আদায়কৃত অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে শরীয়তপুর জেলায়। ওই জেলার বেঞ্চ সহকারী ইমাম উদ্দিন এসব অর্থ গায়েব করেছেন। তাকে সহায়তা দেন তার স্ত্রী কমলা আক্তার। শরীয়তপুরের ডিসি রাম চন্দ্র দাসের স্বাক্ষরে পাঠানো এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, ইমাম উদ্দিন বেঞ্চ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ৩০ জন ম্যাজিস্ট্রেট মোট ৮৫৪ দিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। এই সময়ে মোবাইল কোর্ট কর্তৃক আরোপিত ও আদায়কৃত জরিমানার অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি খাতে জমা দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ইমাম উদ্দিন গ্রহণ করেন। ওই টাকা সরকারি খাতে জমা দেয়ার নাম করে ব্যাংকের উদ্দেশ্যে অফিস থেকে বের হন। কিন্তু টাকাগুলো ব্যাংকে জমা না দিয়ে ৭৬৪ টি ভুয়া চালান তৈরি করেন। তৈরি করা ৭৬৪টি চালান মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের দেখিয়ে তা রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করেন। রেজিস্ট্রারে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর নেন এবং অফিসে তা সংরক্ষণ করেন। নিখুঁতভাবে প্রস্তুতকৃত চালানগুলো দেখতে প্রকৃত চালানের মতোই, সোনালী ব্যাংক, শরীয়তপুর শাখার সিল এবং নির্ধারিত স্থানে ব্যাংক কর্মকর্তার স্বাক্ষর রয়েছে। এসব স্বাক্ষর জাল এবং ইমাম উদ্দিন নিজে এগুলো স্বাক্ষর করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। ইমাম উদ্দিন এসব কার্যক্রম এতো নিপুণভাবে করেছেন যে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট, জে,এম শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জে,এম শাখার অন্য কর্মচারী বা অন্য কেউই কখনও কোন সন্দেহ বা অবিশ্বাস করেনি। তাই ইমাম উদ্দিন সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে এসব অপকর্ম করেছেন। অভিযুক্ত কর্মচারী গত ১লা জুন থেকে পলাতক রয়েছেন। তার স্ত্রী গত ১৮ই জুন থেকে জেল হাজতে আছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে মামলার পাশাপাশি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় তাদেরকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এদিকে সরকারি অর্থ কোষাগারে জমা দেয়ার বিষয়ে জারি করা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিপত্রে বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, উপজেলা ভূমি অফিস, ইউনিয়ন ভূমি অফিস এবং ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক সায়রাতমহাল ইজারার অর্থ/লাইসেন্স ফি/ভ্রাম্যমাণ আদালতের অর্থদণ্ড/ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয়ে থাকে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কোন কোন ক্ষেত্রে আদায়কৃত অর্থ যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণে যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট খাতে জমা দেয়া হয় না। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়মের আশঙ্কা থেকে যায়। উপযুক্ত প্রেক্ষাপটে মাঠ পর্যায়ের সাধারণ ও রাজস্ব প্রশাসন কর্তৃক সায়রাতমহাল ইজারার অর্থ/লাইসেন্স ফি/ ভূমি উন্নয়ন কর/ভ্রাম্যমাণ আদালতের অর্থদণ্ড ইত্যাদি আদায়ের পর অতি দ্রুত যথাযথভাবে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার ক্ষেত্রে ছয় ধরনের বিষয় অনুসরণের অনুরোধ জানিয়ে পরিপত্রে বলা হয়েছে, আদায়কৃত অর্থ বা ফি অবশ্যই নির্ধারিত রশিদের মাধ্যমে আদায় করতে হবে এবং রশিদের মূলকপি সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে দিতে হবে। ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ (ডিসিআর) যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। আদায়ের দিন বা পরবর্তী কার্য দিবসে আদায় করা অর্থ নির্ধারিত চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসে অন্তত একবার এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা দেয়ার বিষয়টি তদারক করবেন। বিভিন্ন জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মাঠ প্রশাসন চালাতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে মোবাইল কোর্ট ছাড়া বর্তমানে অন্য কোন অস্ত্র নেই। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্টের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে মোটা অঙ্কের অর্থদণ্ড আদায় করা হচ্ছে। তাৎক্ষণিক রশিদ বা প্রত্যয়নপত্র না দিয়ে জরিমানার অর্থ নিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে অনেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। মাঠ প্রশাসনে কর্মরত এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা বা টার্গেট পূরণে মোবাইল কোর্টের অপব্যবহার করতে হচ্ছে। এটা ঠিক হচ্ছে না। এক সময় দেখা যাবে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের মতো মোবাইল করার ক্ষমতাও থাকবে না নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের। তখন মাঠ প্রশাসন চালাতে নতুন সমস্যায় পড়তে হবে।

No comments

Powered by Blogger.