মানব সত্তার সিঁড়িতে ওঠা by হোসনে আরা

আমার প্রিয় লেখক মোতাহার হোসেন চৌধুরী মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সাথে তুলনা করেছেন। জীব সত্তা সেই ঘরের নিচের তলা। আর মানব সত্তা তথা মনুষ্যত্ব ঘরটির দোতলা। এই জীব সত্তার মানুষগুলোকে লেখক ব্যক্তিগত লোভ লালসাপূর্ণ এমন একটি ঘরের বাসিন্দা বলেছেন, যাদের চাওয়ার কোন শেষ নেই। এরা হিংসা বিদ্বেষ, ক্রোধ, প্রতিহিংসা, পরনিন্দা, পরশ্রিকাতরতা, অহংবোধ, ঝগড়াটে, লোভী, মিথ্যেবাদী- এসব দোষের কালো থাবার এক হায়েনা। এই মানুষ গুলো পশুসম। আমার বিবেকের নিউক্লিয়াস থেকে মনে হচ্ছে এরা পশুর চেয়ে অধম। এক কথায় বড় বড় নাম না জানা সাপ। এদের নিশ্বাসে ভেতরে অক্সিজেন প্রবেশ করলেও সেটি মানুষটির রক্তের সাথে, মগজের সাথে, ধমনীর সাথে, শিরা উপশিরা এবং হৃদপিন্ডের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও বিষ বাষ্প বের করে। এই শ্রেণীর শুধু প্রাণই আছে। মন মনন বিবেক বলে কিছু নেই। শিক্ষিত-অশিক্ষিত নারী-পুরুষ ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণীর মানুষ এই দলের অন্তর্ভূক্ত। এরা মুখে মধু অন্তরে বিষ। আবার কারো কারো অন্তরেও বিষ মুখেও বিষ। আচার ব্যবহার কথা বার্তা কাজে কর্মে চলনে বলনে প্রতিনিয়ত এদের বিষ বাষ্প নির্গত হয়।
এই মানুষদের মনে কোন শান্তি নেই। একটা অস্থিরতা তাদের সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়। অর্থ সাধনাই তাদের জীবন সাধনা। ভ্রান্ত শিক্ষা এবং পারিবারিক প্রশিক্ষণহীনতা এই তলার মানুষগুলোকে এমনই বিশৃঙ্খলা করে দেয় যে, তারা অনেকটা জাতে মাতাল তালে ঠিক। মুক্ত ঘণ নীল আকাশ, নি:সীম নীলিমা, সাগরের অবারিত জলরাশি, সবুজের সমারোহ- মহান স্রষ্টার এতসব নেয়ামত তাদের মনে অনুরণণ তোলে না। লেখক জীব সত্তার মানুষ গুলোকে দোতলায় উঠাবার প্রধান নিয়ামক হিসেবে শিক্ষাকে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আমার মনটা এটাতে সায় দেয় না। বরঞ্চ শিক্ষার পাশাপাশি যে বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি তা হচ্ছে একটি কঠোর পারিবারিক প্রশিক্ষণ। এই পারিবারিক শিক্ষা তথা প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক নামধারী শিক্ষিত ব্যক্তিরা এখনো জীব সত্তায় বসবাস করছেন। সাধারণ সৌজন্যবোধটুকু তাদের যেন নেই। নির্লোভ-ব্যক্তি মানসের অন্যতম গুণের একটি। এই গুণটি হতে অন্যান্য গুণগুলো উৎসারিত হয়। লোভী মানুষের মাঝেই রয়েছে স্বার্থপরতা, হিংসা, প্রতিহিংসা। অহংকারের ধুম্রজালে তারা অন্যমানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। মহান স্রষ্টা এই বিশ্বভ্রক্ষ্মান্ডটাকে সৃষ্টি করেছেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। পৃথিবী মানুষের জন্য একটি পরীক্ষাগার। এখানে তার অবস্থান অত্যন্ত স্বল্পকালের। এই অস্থায়ী পৃথিবীতে সামান্য স্থায়ীত্বের কথা ভেবে আমাদের চলে কতই না আয়োজন-নিয়োজন। বৈধ অবৈধ যেভাবে পারি আমরা টাকা কামাইয়ের নেশায় মত্ত থাকি। ভুলে যাই মা-বাবা ভাই বোন, গরিব আত্মীয়-স্বজনকে। যদি একবার বিবেক দিয়ে ভাবি আমাদের প্রতিটি কাজের হিসাব আল্লাহ তায়ালা নেবেন, তাহলে মনে হয় আমরা আখিরাতের জন্য কামাইয়ের চিন্তা করতাম। প্রতিটি কাজই ইবাদত সম-যদি তা ধর্মীয় অনুশাসনে থাকে এবং বৈধ হয়। একটু মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করলেই আমরা অনেক ভাল কাজ করতে পারি। অন্যায় অবৈধতা থেকে দূরে থাকতে পারি। ভাল কথা বলা, ভাল কাজ করা, ভাল চিন্তা করা, নারী ও শিশুদের প্রতি অবিচার না করা, পরিশ্রম করা , পরিশ্রমের মূল্য দেয়া, হালাল কামাইয়ের খাবার গ্রহণ করা, ইসলামের বর্জনীয় খাবারগুলো না খাওয়া, সদুপদেশ দেয়া, কারো নামে মিথ্যা তথ্য প্রচার না করা, কাউকে যাঁতাকলে নিষ্পেষিত না করা, নিজের জন্য যেটা পছন্দ করি অপর মুসলমান ভাইয়ের জন্যেও তা করা, ওজনে কম না দেয়া, কথা দিয়ে কথা রাখা, না রাখতে পারলে আগে থেকেই বলে দেয়া, নিরপেক্ষ বিচার করা, মনের মহানুভবতা সৃষ্টি করা, অহেতুক মানুষকে কষ্ট না দেয়া, ধনী গরিব উঁচু নিচু- সবাইকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেয়া- এসব কিছুই ভাল মানুষের গুণাবলী।
ভাল হতে গেলে, টাকা পয়সা  ধন দৌলত লাগে না। মনের ইচ্ছা শক্তিটাই যথেষ্ট। বেশি মাত্রায় কথা বলা উচিত নয়। এতে মুখে ফালতু কথা এসে যেতে পারে। সর্বাগ্রে মিথ্যা পরিত্যাগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মিথ্যাই সকল পাপের জননী। কথায় কথায় বাহাদূরী আর কসম খাওয়া ঠিক নয়। যে কাজ বা কথাটির জন্য কসম খাওয়া হল সেটি ভঙ্গ হলে কাফফারা দিতে হয়। পরনিন্দুক ব্যক্তি মহাপাপী। বয়সে মুরুব্বীদের সম্মান করতে হবে। পাশাপাশি ছোটদের ¯েœহ দিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে পদমর্যাদা তথা বয়ষ্কদের সম্মান দিয়ে কথা বলা উচিত। নিজেকে ফেতনা ফ্যাসাদ থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে হবে। সামর্থ্য থাকলে কার্পন্য করা ঠিক নয়। নিজের দুটো হাত, মুখ এবং শক্তি দ্বারা অপরকে প্রবঞ্চনা করা ঠিক নয়। ইবলিশ ও কুপ্রবৃত্তি মানুসের চরম শত্রু। নফস বা কুপ্রবৃত্তি দূর করা যদিও কঠিন, তবুও নিজের প্রয়োজনেই তা করতে হবে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) আমাদের জীবনের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারেন। তিনি ছিলেন, বিশ্বমানবের ত্রাণকর্তা। মানব চরিত্রের যত মহৎ গুণ থাকতে পারে, তার চরিত্রে  সে সমস্ত গুণের সমাবেশ ঘটেছে। দরিদ্র এতিম অবস্থা থেকে রাজ্য শাসকের মযাদায় আসীন হয়েও একটি মুহূর্তের জন্যও তিনি বিশ্বাসচ্যুত হন নি। অতি কিশোর বয়সে তিনি সত্যবাদীতার জন্য আলামীন খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। বর্তামানে একটু অর্থ বিত্তের ছোঁয়া পেলে আমরা ভুলে যাই নিজের অতীত। নিজের হাতে কোন কাজ করতে চাই না। টাকার অহমিকায় কিংবা ক্ষমতার দম্ভে কেনা গোলাম ব্যবহার করি। মনে মনে ভাবি, সূর্যোদয় থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত গোলামটি আমার হাত পা টেপা থেকে শুরু করে খাওয়াটি পর্যন্ত গিলিয়ে দেবে। এখনও অনেক গৃহকর্তা এবং কর্তৃ নূন্যতম ভুলের জন্য দাস-দাসীর শরীরে আগুণের ছ্যাঁকা দেয়। হাতে প্রহার করে, লাঠি পেটা করে। আর তা না হলে মা-বাবা তুলে গালমন্দ করে। ভুলে যায় তারাও মানুষ। হাদীসে এসেছে “মজুরের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।” মহানবী তাঁর বিদায় হজে দাস দাসী সম্পর্কে বলেছেন, তোমরা দাস দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার কর। তাদেরকে নির্যাতন করবার অধিকার তোমাদের নেই। নিজেরা যা খাও, যে বস্ত্র পরিধান কর, তাদেরকেও অনুরূপ খাদ্য ও বস্ত্র দান করবে। ”
সে সময় প্রাচীণ গ্রীস, রোমান ইহুদী ও খ্রিস্টান জগতে বিশেষ করে আরব সমাজে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। মনিবগণ ছিলেন, গোলামদের জীবন মরণের প্রভু। সেজন্য তাদের প্রতি অমানুষিক অত্যাচার করতে তারা অভ্যস্ত ছিলেন। মানুষ হিসেবে গোলামদের কোন স্বীকৃতি ছিল না। দাসদাসীরা তখন পণ্যের মত বাজারে বেচা কেনা হতো। মহানবী (স:) দাস প্রথার উচ্ছেদ সাধণ করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, “গোলামকে আজাদী দানের চেয়ে, শ্রেষ্ঠতর কাজ আল্লাহর কাজে আর কিছু নেই। ” গোলামীর কথাটি এখানে এ কারণে এসেছে যে, এই এক বিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের মত আচরণ করছি। মানুষের উচিত সার্বক্ষণিক মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। মহানবী (স:) বলেছেন, “চোখের পলক ফেলতে পারবো কি পারবো না এর ভেতর দিয়ে মৃত্যু এসে যেতে পারে।” আল্লাহ পাকের পরিচয় খুঁজতে আমাদের অনেক দূরে যেতে হবে না। আমাদের শরীরের গঠনের দিকে তাকালেই যদি চিন্তা করি কোন সত্তা আমাদের চলার জন্য দুটো পা দিয়েছেন দেখবার জন্য দুটো চোখ দিয়েছেন- তাহলেই আল্লাহ পাকের পরিচয় জানা যাবে। যে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পেরেছে সে প্রভুকে চিনতে পেরেছে। সূরা আত-তীনের উদ্বৃতি দিয়ে বলা যায়- (১) আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অতি উত্তম গঠনে সৃষ্টি করেছেন। যথাযথই মানুষের গঠন অতুলনীয়। (২) অতি সুন্দর আকৃতিতে তৈরী করবার পর তিনি মানুষকে দিয়েছেন জ্ঞান। এই জ্ঞানের বলেই সে সমগ্র সৃষ্টির সেরা বিবেচিত হয়েছে। তার চেয়ে অধিক শক্তির অধিকারীকে নিজের অনুগত করেছে। (৩) যখন মানুষ নিজ দেহ ও শক্তিকে অন্যায় ও পাপের কাজে প্রয়োগ করে, তখন সে ধীরে ধীরে অধ:পতনের এমন অতল তলে নিমজ্জিত হয়, যার নীচে আর কোন স্তর নেই। লোভ লালসা, কামনা বাসনা, হিংসাদেশ, ক্রোধ মানুষকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে দেয়। মানুষের এই হিংস্রতা ও বর্বরতার সাথে কোন হিংস্র জন্তুর তুলনা হয় না।
(৪) মহান আল্লাহ অপরাধীকে কঠিন শাস্তি এবং পূণ্যবান ব্যক্তিকে কল্পনাতীত পুরস্কারের ব্যবস্থা করবেন।
প্রকৃতিতে আটদশটা প্রাণী আপন গতিতে বনের লতাপাতা খেয়ে বড় হয়ে উঠে। এই পশূকূল অন্য প্রাণী ধরে খায়। কখনো মানুষকেও গিলে খায়। এরা যেখানে সেখানে অবাধে চলাফেরা করতে পারে। এদের খাওয়া দাওয়ায় হারাম হালালের ব্যবস্থা নেই। এদের দায়িত্ববোধ নেই। মা-বাবাকে দেখা লাগে না, ছোট ভাই বোনকে লালন পালন করতে হয় না। বিবেক খাটিয়ে কিছু করতে হয় না, কাউকে কথা দিয়ে কথা রাখতে হয় না। মানবকূলের কোন স্বচছল পরিবারে যাদের জন্ম সে পরিবারের সদস্যদের লালন পালন করতে, লেখাপড়া করাতে, শিক্ষিত বানাতে পিতা-মাতার অনেক অর্থব্যয়, শ্রম ব্যয় এবং সময় ব্যয় হয়। কিন্তু যদি মানবিক গুণ সম্পন্ন করে সন্তানকে গড়ে তোলা না যায়, তাহলে ঐ পশুর মতই বেড়া ওঠাই হবে, আর জীব সত্তাতেই অবস্থান করতে হবে।
জীবন দোতলা অর্থাৎ মানব সত্তা তথা মনুষ্যত্ব লোকে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। লেখক এক পর্যায়ে বলেছেন, “শিক্ষার মূল লক্ষ্য জ্ঞান বিতরণ নয়, মূল্যবোধ সৃষ্টি।” মানব সত্তায় পৌছে, একজন মানুষ বুঝতে পারে অর্থ সাধনার চেয়ে জীবন সাধনা অনেক বড়। আর জীবন সাধণাতেই অন্তরের মুক্তি। প্রকৃত শিক্ষিত লোক যখন, মনুষ্যত্বর স্বাদ পায় তখন সে বোঝে, লোভে পাপ, পাপে মরণ,- নিছক কোন বুলি নয় বাস্তব সত্য। লোভের কারণে মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। অনুভূতির রাজ্যে সে হয়ে পড়ে নি:স্ব রিক্ত। মানব সত্তার মানুষেরা লোভের ফাঁদে পা রাখতে ভয় পায়। আসলে শিক্ষা মানুষের বাইরের ব্যাপার নয়, মনের ব্যাপার। অর্থ কামাই করতে এম এ পাস লোকের প্রয়োজন নেই। যে শিক্ষা মানুষের মোহ মুক্তি ঘটিয়ে, জৈবিক চাহিদা ছাড়িয়ে, মনুষ্যত্বের সাথে পরিচিত করে- সেটাই প্রকৃত শিক্ষা। লেফাফা দুরস্তি আর শিক্ষা এক কথা নয়। সুতরাং আর দেরী না করে আসুন আমরা এই পবিত্র রমজান মাসে মানব সত্তার সিঁড়িতে পা রাখি। কারণ হাতে সময় কম। আমরা অতি দ্রুত মৃত্যু নামক নির্মম সত্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কার ভাগ্যে কখন ডংকা বাজবে, সে তো জানেন মহান সৃষ্টিকর্তা।
লেখক
সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, গ্রামীণ ব্যাংক
জোনাল অফিস, নোয়াখালী।

No comments

Powered by Blogger.