পচা গমের উৎকৃষ্ট সার্টিফিকেট নিজেরাই নিজেদের দিচ্ছে খাদ্য বিভাগ by দীন ইসলাম

খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে পচা গম দেখিয়ে খাদ্য বিভাগের সচিব মুশফেকা ইকফাৎকে ভর্ৎসনা করেছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গমে খারাপ কিছুর অস্তিত্ব পায়নি খাদ্য বিভাগ ও খাদ্য অধিদপ্তর। বরং পচা গমের উৎকৃষ্ট সার্টিফিকেট এখন নিজেরাই নিজেদের দিচ্ছেন তারা। সব জেলার গমের স্যাম্পল পরীক্ষা না করে মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করা  নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত পচা গম খাদ্য অধিদপ্তরের ল্যাবরেটরিতেই পরীক্ষা করা হচ্ছে। নিজেদের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এসব গম খাবার উপযোগী বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। যদিও ব্রাজিল থেকে পচা গম আমদানির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়ার পর কেটে গেছে দুই সপ্তাহের বেশি সময়। এখন নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে টিআর-কাবিখা ও ওএমএসের মাধ্যমে ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত পচা গম বিতরণের মাধ্যমে গোডাউন খালি করা হচ্ছে। এর ফলে পচা গমে তৈরি আটা খেতে বাধ্য করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নিম্ন আয়ের মানুষ। এদিকে ১৪টি জেলা থেকে সংগৃহীত স্যাম্পল পরীক্ষা করেই ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গম উৎকৃষ্ট বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তর নিজেরাই। এসব পরীক্ষায় ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গমের মান সন্তোষজনক বলা হচ্ছে। এ বিষয়ে খাদ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, আমরা বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকেও গমের স্যাম্পল পরীক্ষা করাব। খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দফায় খাদ্য অধিদপ্তরের পরীক্ষাগারে ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গমের মান খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দফায় দফায় তাদের গবেষণাগার ব্যবহারের মাধ্যমে কারসাজি করে ওই গমকে বিনির্দেশ অনুযায়ী সন্তোষজনক দেখিয়েছে। যদিও খাদ্য অধিদপ্তরের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা ব্রাজিল থেকে আনা গমকে পশু খাদ্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আর খাদ্য গুদাম থেকে নমুনা সংগ্রহকারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা বলছেন, এ ধরনের গম তারা আগে দেখেননি। তাই খাদ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বলছেন, প্রশ্ন উঠা গম তৃতীয় কোন গবেষণাগারে পরীক্ষা করানো দরকার। এদিকে ব্রাজিল থেকে গমের বিষয়ে গত বুধবার খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. কাউসার আহাম্মদের পাঠানো ব্যাখ্যায় বলা হয়, গম নিয়ে বিরূপ সংবাদ প্রকাশের পর সারা দেশ থেকে ডিসিদের মাধ্যমে সিলগালা অবস্থায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেগুলো পরে গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়। ব্রাজিল থেকে আনা গম চুক্তিতে উল্লিখিত শর্ত অনুযায়ী পাওয়া গেছে। টেস্ট রিপোর্টে পচা কিংবা মানুষের খাবার অনুপযোগী কোনো গম পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় কোন গবেষণাগারে পচা গম পরীক্ষা করা হয়েছে, তা বলা হয়নি। নমুনা কি খাদ্য অধিদপ্তরের নিজস্ব গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়েছে? যদি তাই হয়, তাহলে পরীক্ষার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মানুষের খাবার অনুপযোগী কোন গম পাওয়া যায়নি। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) গত ১০ই জুন পুলিশ সদর দপ্তরকে লিখিতভাবে জানিয়েছে, এসব গম থেকে  তৈরি আটা চার-পাঁচ দিনের বেশি মজুদ রাখলে তাতে পোকা ধরছে। একই অভিযোগ রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশেরও। পুলিশ বিভাগে রেশন হিসেবে চালাতে ব্যর্থ হলেও এই গম টিআর-কাবিখা কর্মসূচিতে দেওয়া হচ্ছে। টিআর-কাবিখার গম বাজারেও বিক্রি হয়। সেখান  থেকে সাধারণ মানুষ এসব গম কিনে খাচ্ছে। একই সঙ্গে ওএমএসের মাধ্যমেও এ গমের আটা সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশ থেকেই আসছে পচা গমের নমুনা। পাশাপাশি পুলিশের ১০টি ইউনিট থেকেও নমুনা পাঠানো হয়েছে। সিরাজগঞ্জ থেকে ৫, লালমনিরহাট থেকে ২, নীলফামারী থেকে ২, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা থেকে ১১, ঝিনাইদহ থেকে ৬, বান্দরবান থেকে ৪, নড়াইল থেকে ৪, গাইবান্ধা থেকে ৬, জামালপুর থেকে ২, ময়মনসিংহ থেকে ২, কুড়িগ্রাম থেকে ৪, দিনাজপুর থেকে ১৪, জয়পুরহাট থেকে ২, সাতক্ষীরা থেকে ৯, ফেনী থেকে ৬, নারায়ণগঞ্জ  থেকে ৫, রাঙ্গামাটি থেকে ৭, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১০, পটুয়াখালী থেকে ৮, রংপুর থেকে ৪, হবিগঞ্জ থেকে ৮, সুনামগঞ্জ থেকে ১, বগুড়া থেকে ৪, মৌলভীবাজার থেকে ২, সিলেট  থেকে ৩, চুয়াডাঙ্গা থেকে ১, মাগুরা থেকে ৫, শেরপুর থেকে ৩, বরগুনা থেকে ৬,  গোপালগঞ্জ থেকে ৪, মুন্সীগঞ্জ থেকে ৫ ও চাঁদপুর থেকে ৫ প্যাকেট গমের নমুনা খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। এসব পরীক্ষা শেষ করার আগেই ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গম সন্তোষজনক বলে প্রচার করছে খাদ্য অধিদপ্তর ও খাদ্য বিভাগ।

No comments

Powered by Blogger.