হিমালয়ের পথে চট্টগ্রামের তারুণ্য by আহমেদ মুনির

পাঁচ হাজার ৭০০ মিটার উচ্চতার থার্পুচুলি পর্বতের
চূড়ার দিকে যাত্রা। খারাপ আবহাওয়ার জন্য ৪০০
মিটার নিচ থেকে ফেরত আসতে হয় অভিযাত্রীদের
নেপালের অন্নপূর্ণা হিমবাহের ৪ হাজার ৪০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত থার্পুচুলি পর্বতের বেসক্যাম্প। রাত তখন ১২টা ৪৫ মিনিট। যাত্রা শুরু হয় থার্পুচুলি পর্বতের চূড়ার দিকে। হিমবাহের ৬০ ডিগ্রি খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে হচ্ছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশে তারাও নেই। সবার মাথায় হেড ল্যাম্প। হঠাৎ পেছনে চিৎকারের শব্দ। সেই সঙ্গে কোমরে হ্যাচকা টান। নিচে তাকাতেই গা হিম হয়ে আসে। একজন নিচে ঝুলে আছেন। সবাই মিলে তাঁকে টেনে তোলার পর আবার যাত্রা শুরু। পরদিন বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত হেঁটে চূড়ার খুব কাছে পৌঁছালে শুরু হয় তুষারধস।
২০১৪ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকাভিত্তিক অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব দ্য কোয়েস্টের আয়োজনে থার্পুচুলি পর্বতে এমন বিপৎসংকুল অভিযানে অংশ নেন দেবাশীষ বল। তুষারধসের কারণে চূড়ার ২০০ মিটার নিচ থেকেই ফিরে আসতে হয় সেবার। অভিযান সফল না হলেও পোক্ত হয়েছে অভিজ্ঞতার ঝুলি। চট্টগ্রামের পর্বত আরোহণ ক্লাবের সদস্য হিসেবেই পেশায় শিক্ষক দেবাশীষ অংশ নিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা অভিযানে। চট্টগ্রামে পর্বত আরোহণ ক্লাব? দেবাশীষই জানালেন তার আদ্যোপান্ত। গত বছর বান্দরবানের আলীকদম গুহায় বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। দেখলেন পর্যটকদের ফেলে যাওয়া চিপসের প্যাকেট, পানির বোতলসহ বিচিত্র আবর্জনায় নোংরা হয়ে আছে গুহা। পরিচ্ছন্নতা অভিযানের ডাক দিয়ে ফেসবুকে ইভেন্ট খোলেন ফিরে এসেই। আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২০১৪ সালের ১২ এপ্রিল আট তরুণ জড়ো হন আলীকদেম। গুহার পাশেই ক্যাম্প ফেলেন তাঁরা। ময়লা–আবর্জনা পরিষ্কারের পর আলাপ গড়াতে থাকে অভিযান বিষয়ে। ঠিক হয় চট্টগ্রামে একটা পর্বত আরোহণ অর্থাৎ মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব গড়ে তুলবেন তাঁরা।
পর্বত আরোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমারসের সদস্যরাl জুয়েল শীল
সে বছরের ৩০ মে তরুণ ভার্টিক্যাল ড্রিমারস নামে চট্টগ্রামে প্রথম মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের যাত্রা শুরু হয় তাঁদেরই উদ্যোগে। এরপর প্রায় বছর খানেক কেটে গেছে। পর্বত আরোহীদের এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যাও ৫০ ছাড়িয়েছে। অভিযাত্রী দলের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, ব্যাংক কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত এক বছরে দেশ–বিদেশের পাহাড়ে-পর্বতে ৪২ বার অভিযানে গেছেন সংগঠনের সদস্যরা। এর মধ্যে আছে নেপালের ল্যাংটাংয়ে সুরিয়া পিক, সারগো রি, অন্নপূর্ণা পর্বতমালার থার্পুচুলি পর্বত, কেয়ানজিং রি, বাংলাদেশের সাফা হাফং, জ ত্লাং, দুম লং ও জোগি হাফঙের মতো উঁচু পাহাড়।
২০ জুন পার্বত আরোহী দলের জনা দশেক সদস্যের সঙ্গে আড্ডা হয় প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে। আলাপের শুরুতেই এভারেস্টের প্রসঙ্গ আসে। কবে এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারবে চট্টগ্রামের তরুণেরা? সংগঠনের সদস্যরা বলেন, ‘আমাদের যে প্রস্তুতি তাতে আর দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই সম্ভব হবে এটা। তবে এভারেস্টে যেতে মোটা অঙ্কের ফি গুনতে হয়। তাই পৃষ্ঠপোষক না পেলে কাজটা কঠিন হবে।’
বনে বাদাড়ে ট্র্যাকিং, সাইক্লিং, সাঁতার, পর্বত আরোহণের প্রশিক্ষণ, হিমালয়ের বিভিন্ন পর্বতমালায় অভিযান—এসব তো আছেই। পাশাপাশি মানবিক কার্যক্রমেও অংশ নেন ভার্টিক্যাল ড্রিমারসের সদস্যরা। সংগঠনের একজন সদস্য রুপা দত্ত নিজের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের লামা, আলীকদম ও কক্সবাজারে চারটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ ছাড়া বনে জঙ্গলে পরিচ্ছন্নতা অভিযান, শীতার্তদের শীতবস্ত্র বিতরণের কার্যক্রমও করেন তাঁরা।
সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে কেউ তহবিল, কেউ ওয়েবসাইট পরিচালনা, কেউ পরিবেশবিষয়ক দিক আর কেউ বা আইন-কানুনের বিষয় দেখেন। আইন-কানুনের বিষয়টা কি রকম? নেপালের লেংটাং অঞ্চলের ১৬ হাজার ৭০০ ফুট উচ্চতার সুরিয়া পিক জয় করা আরোহী ফারহান জামান ব্যাখ্যা করেন, অভিযানে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি সাধন, খাবারের উচ্ছিষ্ট বা প্যাকেট ফেলা নিষিদ্ধ। আর ফিটনেস না থাকলে বিশেষ অভিযানের জন্য কাউকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। এ বিষয়ে সংগঠনের সদস্য তানভিরের আছে মজার অভিজ্ঞতা। পর্বত আরোহণের জন্য তাঁকে দশ কেজি ওজন কমাতে হয়েছে।
সংগঠনের পক্ষ থেকে মাসে এক থেকে দুবার মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনায় র্যাপলিং, জুমারিং ও রক ক্লাইম্বিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। খটমট নামগুলো আসলে পর্বত আরোহণের নানা কৌশল। বুঝিয়ে বললেন পেশায় চিকিৎসক বাবর আলী। খাঁড়া পর্বতে দড়ি ধরে ওঠা-নামা হলো র্যাপলিং আর জুমারিং। আর রক ক্লাইম্বিং হলো খাঁড়া পর্বত বেয়ে ওঠা।
২০১৪ সালের অক্টোবরে নেপালের গোসাইকুন্ডের ৫ হাজার
১৪৫ মিটার উচ্চতায় সূর্য পর্বতের চূড়ায় ভার্টিক্যাল ড্রিমারসের
দুই সদস্য ফারহান জামান ও বাবর আলী l ছবি: সংগৃহীত
কী কী জিনিস প্রয়োজন হয় অভিযানে যেতে হলে? ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফ নেওয়াজ জানান, পাহাড়ি পথের জন্য ভালো গ্রিপের স্যান্ডেল আর পর্বতের জন্য ট্র্যাকিং বুট পরতে হবে। পাশাপাশি সরু লাঠি বা ট্র্যাকিং পোল, ব্যাকপ্যাক, তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, জিপিএস, পেনি স্টোভ নামের ছোট চুলা, টর্চ, খাওয়ার স্যালাইন, শুকনো খাবার এসব সঙ্গে নিতে হবে। আর পার্বত্য এলাকায় গেলে বর্ষায় ছোট ঝিরি-ঝরনায় নামার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে। এসব ঝরনায় হঠাৎ করেই স্রোত আছড়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের দন্ত বিভাগ থেকে পাস করা সিফাত আরা ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী অবন্তিকা হোসেনও এই দলের সদস্য। দলের অন্য সদস্যরা জানালেন, প্রশিক্ষণে বরাবরই দুর্দান্ত এই দুই নারী। বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা পাহাড়ে ট্র্যাকিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে দুজনেরই। তবে এর মধ্যে থানচির দুর্গম চেমা খাল ধরে ট্র্যাকিং করেছেন অবন্তিকা। একবার তো বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছেন অল্পের জন্য। অবন্তিকা নিজেই বললেন সে ঘটনা, ‘বান্দরবানের এক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠেছি চূড়ায়। অনেক উঁচু পাহাড়। চূড়ায় উঠে হঠাৎই পা পিছলে পড়তে শুরু করলাম। তবে শেষমেশ কিছু দূর গিয়ে পতন ঠেকিয়েছি। সে যাত্রায় ভাগ্যের জোরে বেঁচে গিয়েছি।’
১৬ জুলাই ভার্টিকেল ড্রিমারসের দশ সদস্যের একটি দল আবারও বের হচ্ছেন অভিযানে। এবারের গন্তব্য ভারতের হিমাচল প্রদেশের পর্বতমালা।
এরপর কী? মনে কতদূর যেতে চান চট্টগ্রামের অভিযাত্রীরা? দেবাশীষ বল বললেন, ‘উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু, পৃথিবীর সব পর্বত চূড়াই জয় করতে চাই আমরা।’

No comments

Powered by Blogger.