আত্রাইয়ের ৯ যুবক ২ বছর ধরে নিখোঁজ অপেক্ষায় স্বজনরা by একেএম কামাল উদ্দিন টগর

আত্রাইয়ের ৯ যুবক ২ বছর ধরে নিখোঁজ। অপেক্ষার প্রহর গুনছেন স্বজনরা। মানব পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে সাগরপথে নওগাঁর আত্রাইয়ের ওই ৯ যুবক প্রায় ২ বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। তারা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা তা জানেন না স্বজনরা। থাইল্যান্ডে গভীর অরণ্যে গণকবরের সন্ধান লাভ ও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী নাগরিক উদ্ধার ঘটনায় তাদের পরিবারে চলছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। স্বজনদের ধারণা, দীর্ঘদিনে খোঁজ না মেলায় হতভাগ্যদের ভাগ্যে সাগরে সলিল সমাধি ঘটেছে। না হয় থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মানব পাচারকারীর হাতে বন্দি আছেন। এখনও নিখোঁজ সন্তানের পথ চেয়ে বসে আছেন হতভাগ্যদের স্বজনরা। শুধু চোখের পানি ফেলে প্রিয় সন্তানদের স্মরণ করছেন তারা।
জানা গেছে, উচ্চ বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার ইসলামগাঁতী গ্রামের সামাদ ও ময়েজ নামে দুই মানব পাচারকারী গত ২০১৩ সালের ১২ই জুন একই গ্রামের শামসুল রহমানের ছেলে আবু তায়েব প্রাং (২০), চান প্রাংয়ের ছেলে হামিদুল ইসলাম (১৮), সুরুজ প্রাংয়ের ছেলে সজীব প্রাং (১৮), শফির প্রাংয়ের ছেলে মহসিন প্রাং (২৮), জানবক্সের ছেলে মোশারফ হোসেন (২২), মল্লিক মণ্ডলের ছেলে আলতাব মণ্ডল (২৪), মোহাম্মদ শেখের ছেলে মিয়াজান শেখ (৩২), রাণীনগর গ্রামের মজিবর রহমানের ছেলে উজ্জ্বল হোসেন (২৬) ও মেহের আলীর ছেলে খোকন হোসেনকে (২১) সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে নিয়ে যায়। এরপর দেশের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ২৫-২৬ যুবককে প্রথমে নাটোর জেলায় একটি হোটেলে একত্র করা হয়। এরপর বিভিন্ন মানব পাচারকারীর হাত ঘুরে নিয়ে যাওয়া হয় টেকনাফে। এরপর আবদুল্লাহ ও ইসমাইল নামে অন্য দুই মানব পাচারকারীর কাছে তাদের দুটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। তখন আবদুল্লাহ গ্রুপের কয়েক যুবক বুঝতে পারেন তারা বিপদের মুখে আছেন। তখন তারা কৌশলে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসে মানব পাচারকারীর হাত থেকে। আর তারা ফিরে এসে পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি জানান। যুবকদের পরিবারের চাপে মানব পাচারকারীরা কখনও বলে মালদ্বীপ পুলিশের হাতে আটক আছে, কখনও বলে বার্মা দেশে পুলিশের হাতে আটক আছে, আবার কখনও বলে তারা থাইল্যান্ড পুলিশের হাতে আটক আছে। নিখোঁজ যুবকদের ফিরে এনে দেবে বলে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জনপ্রতি আরও ৫০ হাজার টাকা করে মোট সাড়ে ৪ লাখ টাকা হাাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় মানব পাচারকারী সামাদ ও ময়েজ। কিন্তু আদৌ হতভাগ্যদের কোন খোঁজ মেলেনি। এ ঘটনায় মানব পাচারকারী সামাদ ও ময়েজের বিরুদ্ধে আত্রাই থানায় একটি মামলা করা হয়। এদিকে একমাত্র অর্থ উপার্জনকারীদের হারিয়ে নিখোঁজদের স্বজনরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
মহসিন প্রাংয়ের স্ত্রী সম্পা বিবি জানান, তাদের সহায়-সম্পত্তি ও অর্থ উপার্জনকারী বলতে তিনিই একমাত্র ছিলেন। তার উপার্জনেই বৃদ্ধ শ্বশুর, শাশুড়ি ও দুটি শিশু সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে চলতো। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাদের না খেয়ে বেশির ভাগ দিন পার করতে হচ্ছে। এখন তারা কিভাবে বাকি জীবন পার করবেন, একথা বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেলেন।
আবু তায়েবের মা ভানু বেওয়া জানান, তাদের সন্তান হারিয়ে এখন কষ্টে দিন কাটাতে হয়। একবেলা খাবার জোটে না। সন্তানকে কিভাবে দেশ-দেশান্তরে খোঁজ করবো। মানব পাচারকারীদের হাত থেকে পালিয়ে আসা ইসলামগাঁতী গ্রামের হামিদ আলী মোল্লা ও ফেরদৌস প্রাং জানান, মানব পাচারকারীরা প্রথমে নাটোরের একটি হোটেলে তাদেরসহ ২৫ থেকে ২৬ জনকে একত্র করে। বিভিন্ন পথ ঘুরে নাটোর থেকে সবাই টেকনাফ যান। এরপর দুটি গ্রুপে ভাগ হওয়ার পর বিপদ বুঝতে পেরে তারা মানব পাচারকারীর হাত থেকে জীবন নিয়ে বেঁচে আসেন। অন্যদের কোন খোঁজ পাননি।
বিশা ইউপি চেয়ারম্যন আবদুল মান্নান মোল্লা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, জড়িত মানব পাচারকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে নিখোঁজ ৯ যুবকের তাদের পরিবারের কাছে ফিরে দেয়ার দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, মানব পাচারকারীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকায় একের পর এক এ ধরনের কাজ করে পার পায়। যার কারণে মানব পাচারকারীদের কোন বিচার হয় না।
পরিবার ও গ্রামবাসী দ্রুত এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে নিখোঁজদের ফিরিয়ে দিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.