গভীর সমুদ্রবন্দর সোনাদিয়া বাদ, এবার নতুন লড়াই পায়রায় by মিজানুর রহমান

দেশের প্রথম গভীরসমুদ্র বন্দর নির্মাণ নিয়ে রীতিমতো লড়াই শুরু হয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আগ্রহী দেশগুলোর মধ্যে। এ নিয়ে সরকারও পড়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। মিলিয়ন ডলারের ওই প্রকল্প কোথায় হবে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় নাকি পটুয়াখালীর পায়রায়- তা নিয়ে সরকারের ভেতরে-বাইরে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। নীতিনির্ধারকরা পায়রাতেই বন্দরটি নির্মাণে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। কয়েক বছর ধরে সোনাদিয়া নিয়ে আলোচনা চললেও গত ক’মাসে নাটকীয়ভাবে পায়রার কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। পায়রায় বন্দর করা হলে তার কার্যকারিতা কেমন হবে- সেটি যাচাই করতে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানকে সমীক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বৃটেনের খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান ওয়েলিং ফোর্ড গত ফেব্রুয়ারি থেকে সমীক্ষার কাজও শুরু করে দিয়েছে। আগামী অক্টোবর নাগাদ তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা। এদিকে সোনাদিয়াকে বাদ দিয়ে পায়রা প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু হওয়ায় ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী দেশগুলো দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। পররাষ্ট্র, পরিকল্পনা ও নৌ মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে ওই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। সোনাদিয়া নিয়ে বরাবরই আগ্রহী ছিল চীন। সেখানে ভারতও ছিল। প্রতিযোগী দেশের তালিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও জার্মানিও। চীন ও ভারতের দুটি প্রতিষ্ঠানের তরফে পূর্ণ প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সোনাদিয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভারত তা থেকে ফোকাস সরিয়ে এনেছে। চীন এরই মধ্যে পায়রা বন্দর নির্মাণে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে। সেখানে গত মাসে ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস যৌথভাবে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারতের তরফে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব না এলেও ঢাকার কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন সফরে এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব আসতে পারে। ফাস্ট ট্র্যাক মনিটরিংয়ের আওতাভুক্ত গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের যে কোন বড় প্রকল্পে বরারবই প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও চীন। সেখানে কখনও এককভাবে কখনও বা জোটগতভাবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। সরকার অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দেশ দুটির সঙ্গে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে অত্যন্ত স্পর্শকাতর গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা আগাগোড়া সতর্ক। এ জন্য সরকার কিছুটা ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে। তাছাড়া, ওই বন্দরের সঙ্গে নৌ-ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা থাকায় সেখানে এককভাবে কোন দেশকে না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবজমিনকে বলেন, সোনাদিয়ার চেয়ে পায়রায় বন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা জোরালো হওয়ায় নির্মাণে আগ্রহী দেশগুলোর প্রতিযোগিতা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ডেনিশ উন্নয়ন মন্ত্রী সমপ্রতি ঢাকা সফর করে গেছেন। সেখানে অন্য ইস্যুর পাশাপাশি সমুদ্র বন্দর নির্মাণে তাদের আগ্রহের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগেই ঢাকা আসছেন চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী লিউ ইয়ানদং। দেশটির রাজনীতি ও সরকারের সমান প্রভাবশালী ওই নারী রাজনীতিকের ঢাকা সফরকালে অন্য ইস্যুগুলোর পাশাপাশি বন্দর নির্মাণে চীনা প্রস্তাবের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আসবে। আর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফর শেষ হওয়ার পরপরই ঢাকা আসছেন ডাচ্‌ উন্নয়ন মন্ত্রী। ডাচ্‌ ও ডেনিশ মিলে বন্দর নির্মাণের যে প্রস্তাব করেছে মন্ত্রীর সফরে সেটি আরও জোরদার হবে বলে ধারণা ঢাকার ওই কূটনীতিকের। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে তিনি আরও বলেন, প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মধ্যে পদ্মা সেতুর বড় দুটি কাজ পেয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান। এ জন্য দেশটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। আগামী দিনে পায়রা বন্দরসহ অন্য বড় প্রকল্পে তারা যে লড়াই চালাবে সেটিও ইঙ্গিত মিলেছে বলে জানান ওই পেশাদার কূটনীতিক। এদিকে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে কথা বলতে গেলে নৌ-সচিব শফিক আলম মেহেদী মানবজমিনকে বলেন, সোনাদীয়া নয়, আমার কাছে আছে পায়রা বন্দর প্রকল্পের খবর। এখানে দু’টি প্রস্তাব পেয়েছি। চীনা পক্ষ থেকে জি-২ জি প্রস্তাব এসেছে। আর ডাচ্‌ ও ডেনিশ সরকার যৌথভাবে একটি প্রস্তাব দিয়েছে। প্রকল্পটির কারিগরি দিক সমীক্ষা করা হচ্ছে। ওয়েলিংফোর্ড নামের একটি বৃটিশ প্রতিষ্ঠান ওই সমীক্ষা করছে। সমীক্ষা রিপোর্ট পাওয়ার পর কাকে কাজ দেয়া হবে সেটি এককভাবে হবে না আলাদা আলাদা হবে সে ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসবে। ওই প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সচিব বলেন এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে।

No comments

Powered by Blogger.