রোহিঙ্গারাও মানুষ তাদের সমুদ্রে ঠেলে দেয়া যাবে না -অং সান সুচি

মিয়ানমারের বিরোধীদলীয় গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির দল রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখ খুলেছে। তার দলের মুখপাত্র নিয়ান উইন বলেছেন, রোহিঙ্গারাও মানুষ। তাদের সমুদ্রে ঠেলে দেবেন না। যদি তাদেরকে নাগরিক হিসেবে মেনে নাওনেয়া হয় তাহলে তাদেরকে অন্তত সাগরে ঠেলে দেয়া যাবে না। আমি তাদেরকে মানুষ হিসেবে দেখি। তাদেরও আছে মানবাধিকার। রাজধানী ইয়াঙ্গুনে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের এক ফাঁকে তিনি এ কথা বলেন। দু’সপ্তাহের বেশি অবর্ণনীয় অবস্থায় গভীর সমুদ্রে আটকে আছে রোহিঙ্গারা। কিন্তু এ ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরোধী দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমক্রেসি (এনএলডি)র প্রধান অং সান সুচি নিজে দৃশ্যত নীরব। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। এরই মাঝে প্রথা ভেঙ্গে মুখ খুললেন তার দলের মুখপাত্র। নিয়ান উইন মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার। বার্তা সংস্থা এএফপির রিপোর্টে বলা হয়েছে, অং সান সুচির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) এই মুখপাত্র বলেছেন, সাগরে ভাসমান ভয়াবহ দুর্দশায় পতিত এসব রোহিঙ্গা মুসলমানদের ‘মানবাধিকার’ প্রাপ্য। সু চির মুখপাত্র নিয়ান উইন বলেন, নাগরিক হিসেবে তাদের যদি গ্রহণ করা না হয়, তাদের শুধু নদীতে বা ঠেলে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেয়া যাবে না। তারা মানুষ। আমি তাদের মানুষ হিসেবে দেখি যাদের মানবাধিকার রয়েছে। সহিংসতা এড়াতে মিয়ানমারের হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা ও উন্নত জীবিকার আশায় বহু বাংলাদেশী সমুদ্র পথে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাড়ি দিতে গিয়ে চরম দুর্দশার শিকার হয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কখনোই শক্ত অবস্থান না নেয়ায় ও স্পষ্ট কোন বিবৃতি প্রদান না করায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সু চি।
অভিবাসীদের ঠাঁই দিতে চায় ফিলিপাইন
ভয়াবহ দুর্দশায় পতিত কয়েক হাজার বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে রাজি ফিলিপাইন। এ ইস্যুতে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে ‘পিং পং’ খেলা চলেলেও বিপন্ন এসব মানুষের জন্য দরজা খুলে দিতে রাজি ফিলিপাইন। এ সমস্যা সমাধানে মালয়েশিয়াকে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংগঠন ইউএনএইচসিআর। অন্যদিকে আজ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে বৈঠকে বসছেন। সে বৈঠকে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন, ইন্টারন্যাশনাল অফিস ফর মাইগ্রেশন (আইওএম), এ সমস্যার সঙ্গে যুক্ত দেশগুলোর সহায়তা নিয়ে কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী তেনো মারসুদি। তবে এক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ২৯শে মে থাইল্যান্ড এ বিষয়ে যে সম্মেলন আহ্বান করেছে তাতে মিয়ানমার যোগ দেবে কিনা তা নিয়ে এখনও রয়েছে সংশয়। ওই সম্মেলনে এশিয়ার ১৫টি দেশ যোগ দিতে পারে। অন্যদিকে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা গতকালও সমুদ্রে আটকে পড়া মানুষগুলোকে উদ্ধারে আঞ্চলিক তিন দেশের প্রতি জোর আহ্বান জানিয়েছে। বলেছে, বিপন্ন ওই মানুষগুলোতে অন্তত তাদের দেশগুলোতে অবতরণ করতে দেয়া হোক। আইওএম-এর সঙ্গে ওই এজেন্সির যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সমুদ্রসীমায় যেসব মানুষ এখনও ভাসছে তাদের বহনকারী নৌযানগুলোকে যেন ফিরিয়ে দেয়া না হয়। এ অবস্থায় ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি বলেছেন, ইন্দোনেশিয়া এরই মধ্যে বোটের ওইসব মানুষদের জন্য অনেক কিছু করেছে। ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশনে তার দেশ স্বাক্ষর করে নি। একই রকমভাবে জাতিসংঘের ওই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয় থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। এ কনভেনশনে স্বাক্ষর করলে তারা শরণার্থীদের গ্রহণ করতে বাধ্য থাকতো। এ তিনটি দেশই বলেছে তারা অনেক বেশি রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায় রয়েছে হাজার হাজার। সোমবার ইন্দোনেশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট জুসুফ কাল্লা বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যদি তৃতীয় কোন দেশ আশ্রয়ের প্রস্তাব মেনে নেয় তাহলে তারা আন্তর্জাতিক চাপ মেনে নিয়ে রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিতে পারেন। বিবিসি জানিয়েছে, সাগরে আটকে পড়া মানুষের সমস্যা মোকাবিলার জন্য মালয়েশিয়াকে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে ইউএনএইচসিআর। তারা বলেছে, মালয়েশিয়া যেহেতু এরই মধ্যে এসব শরণার্থীর প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়েছে তাই তাদের কাছে চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধা দিতে প্রস্তুত এ সংস্থা। একদিকে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের শিকার মানুষ ও মিয়ানমারের ভাগ্যবিড়ম্বিত রোহিঙ্গারা কয়েক সপ্তাহ অবর্ণনীয়  দুর্দশায় কাটাচ্ছেন সমুদ্রে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এ যাবত ৪৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে ঠাঁই দিয়েছে মালয়েশিয়া। এখন তারা বলছে, আর কোন রোহিঙ্গাকে তারা গ্রহণ করবে না। ইউএনএইচসিআর বলেছে, ওইসব অভিবাসীর এখন সবচেয়ে প্রয়োজন কি তা নির্ধারণ করতে আটকে পড়াদের সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করতে চায়। তবে এ বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোন মন্তব্য করে নি। গত সপ্তাহে মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা বলেন, ১০১৮ বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা শরণার্থী অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে ল্যাঙ্কাবি দ্বীপে। ধরে নেয়া হচ্ছে, পাচারকারীরা তাদের সেখানে ফেলে গিয়েছে। এখন তাদের আটক রাখা হয়েছে। গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের স্থানীয় অধিবাসীরা কমপক্ষে ৭০০ মানুষকে উদ্ধার করেছে। এ নিয়ে সেখানকার বিভিন্ন ক্যাম্‌েট আটক এমন মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ১৫০০। এখনও সমুদ্রে অকল্পনীয় দুর্দশার শিকার কয়েক হাজার বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। দ্রুত সময়ে তাদের মানবিক সহায়তা দিতে ব্যর্থ হলে সাগরেই তারা কফিনে পরিণত হবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে এরই মধ্যে জাতিসংঘ। বোটের ওপর আটকে পড়া এসব মানুষের শরীরের দেখা দিয়েছে মারাত্মক পুষ্টিহীনতা। যারা জীবিত অবস্থায় তীরে উঠতে সক্ষম হয়েছেন তারা বলেছেন, বোটে বা তাদের বহনকারী জাহাজগুলোতে খাদ্য নিয়ে তীব্র লড়াই হয়েছে। এমন লড়াইয়ে কমপক্ষে ১০০ বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাভর্তি একটি জাহাজ ফেলে পালিয়ে যায় এর ক্যাপ্টেন। সেখানে বাংলাদেশীদের সঙ্গে রোহিঙ্গারা তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। পানিতে মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে তা ছিটানো হয় প্রতিপক্ষের দিকে। গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়। কাউকে কাউকে ছুড়ে ফেলা হয় সমুদ্রে। ভাইয়ের সামনে ভাইকে, বোনের সামনে ভাইকে কুপিয়ে লাশ ফেলে দেয়া হয় সমুদ্রে। এই যখন অবস্থা তখন ফিলিপাইন এগিয়ে এসেছে, ঠিক আগেও অনেকবার তারা যেমন মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছিল। এর আগেও এশিয়ার অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের, এমনকি ইউরোপের অনেক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার রেকর্ড আছে তাদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মানুয়েল কুইজোন। তিনি তার প্রশাসনকে নির্দেশ দেন ইউরোপ থেকে পালিয়ে আসা ১৫০০ শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে। গৃহযুদ্ধের পর চীনে কমিউনিস্টদের বিজয়ের পর কয়েক হাজার চীনা নাগরিক আশ্রয় গ্রহণ করেন ফিলিপাইনে।  ১৯৭০ এর দশকে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ভিয়েতনামে। এ সময়ও ভিয়েতনাম থেকে বোটে করে মানুষ যেতে থাকে ফিলিপাইনে। তাদের আশ্রয় দেয়া হয়। তাদের নিয়ে গড়ে উঠেছে পশ্চিমের দ্বীপ পালাওয়ানে ভিয়েতনাম গ্রাম। এর বেশির ভাগ শরণার্থী পরে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে বসতি গড়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.