উপকূলে কান্না থামছে না by রাসেল চৌধুরী

কক্সবাজারে হার্ডলাইনে প্রশাসন। মানব পাচারকারীদের খুঁজছে তারা।  তালিকা ধরে মাঠে নেমেছে তারা। অন্যদিকে সেই তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে বিভিন্ন কায়দা-কৌশলে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে শীর্ষ মানব পাচারকারীরা। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ারে কক্সবাজারে ছয়জনের মৃত্যুর পর জেলার সদর উপজেলা, টেকনাফ, উখিয়া ও মহেশখালীসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় অবৈধ মানবপাচার আপাতত বন্ধ হলেও উপকূলের বিভিন্ন পাড়ায় স্বজনের অপেক্ষায় কাতর স্বজনদের কান্না থামছে না।
ইতিমধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের দালাল থেকে শুরু করে শীর্ষ মানব পাচারকারীদের পর্যন্ত শনাক্ত করতে পেরেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আবার আন্তর্জাতিকভাবে পাচারকাজে জড়িত রয়েছে এমন অনেককেও চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো।  প্রশাসনের তৎপরতায় আপাতত মানবপাচারের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে মানব পাচারকারীরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় স্বজনহারাদের আর্তনাদে আকাশ ভারী হয়ে উঠছে। যে দালালরা প্রতিদিন ফোন করতো মুক্তিপণের টাকার জন্য, সেই দালালদের ফোন এখন বন্ধ; যে কারণে কোন রকম সুখবর পাওয়ার সুযোগ নেই স্বজনহারাদের।
ক্রসফায়ারে মানব পাচারে জড়িত ছয়জন নিহত হওয়ার পর সীমান্তবর্তী এ জেলার ৪৮ পয়েন্ট দিয়ে মানবপাচার আপাতত বন্ধ রয়েছে। তবে, ক্রসফায়ারে নিহতদের সবাই পাচারে জড়িত চুনোপুটি এবং সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা শীর্ষ পাচারকারীরা বহাল-তবিয়তেই রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
মানবপাচারে জড়িতদের সরকারি দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, দলগতভাবে এসব অপকর্মের সঙ্গে কেউ জড়িত নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে যেসব সুবিধাভোগী লোক এসব করছে তাদের নাম প্রশাসনের তৈরি করা তালিকা ও মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। আর যারা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে তারা কেউই নিরীহ নয়। এরা আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছে। তারপর সেটাকে ব্যবহার করে অপকর্ম করছে। বাড়ি-গাড়ি করেছে। এরা বর্ণচোরা। আগে বিএনপি করত। সরকার ও প্রশাসনের সাম্প্রতিক কঠোর পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই।
এদিকে, প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের কারণে কক্সবাজার-উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মানবপাচার আপাতত বন্ধ রয়েছে বলেই বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু নাফ নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী টেকনাফের উত্তর জালিয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাংসহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিখোঁজ তরুণ-যুবকদের পরিবারের সদস্যদের কান্না কিছুতেই থামছে না।
সরজমিনে টেকনাফ পৌর এলাকার উত্তর জালিয়াপাড়ায় গিয়ে সন্তানহারা অনেক পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তাদের কারও সন্তান কারও স্বামী নিখোঁজ রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। সন্তানহারা উত্তর জালিয়াপাড়ার বৃদ্ধ মো. আলম বলেন, নয় মাস ধরে আমার ছেলে আবদুস সোবহানের খোঁজ নেই। তার স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। তারা খুব কান্নাকাটি করছে। এখন নানাজনের মুখে শুনতে পাচ্ছি সে মালয়েশিয়ার কারাগারে বন্দি আছে। কিন্তু ছেলের সঙ্গে নিজে কথা বলতে পারিনি।
সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় আরেক বৃদ্ধা খাদিজা বেগম। ইতিমধ্যে তার স্বামী উম্মাদ হয়ে গেছেন। তিনি বলেন, ৬-৭ মাস আগে আমার ছেলেকে শাহপরীর দ্বীপের দালাল রশিদ আহম্মদ মিস্ত্রি কাজের কথা বলে জোর করে নিয়ে গিয়ে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। কিছুদিন আগে তাকে পেয়ে ধরে পুলিশে দিয়েছি। কিন্তু, আজও ছেলের খোঁজ পায়নি বলেই তিনি ফুপিয়ে কেঁদে উঠেন।
উল্লেখ্য, গত ৬-৭ বছর ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ বিভিন্ন উপকূল দিয়ে সমুদ্র পথে মানব পাচার ব্যাপকহারে বেড়েছে। মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দেশের অভাবগ্রস্ত বিভিন্ন জেলা থেকে দালালরা ১৫-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে নিয়ে এসে ৪৮টি ঘাট দিয়ে ফিশিং ট্রলারে তুলে দেয় পাচারকারীদের হাতে। এরপর তাদের থাইল্যান্ডের শংখোলাসহ জঙ্গলে আটকে রেখে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় মোটা অংকের মুক্তিপণ। এর মধ্যে অনেকেই অনাহারে মারাও গেছে।

No comments

Powered by Blogger.